‘সেরা করদাতার’ প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট ফাঁকি ২৭৫ কোটি টাকা

নিজস্ব প্রতিবেদক: ২০২০-২১ কর বছর ব্যবসায়ী শ্রেণিতে সেরা করদাতা হয়েছেন। তার একটি প্রতিষ্ঠানের রয়েছে বন্ড লাইসেন্স। সেই লাইসেন্স দিয়ে বন্ড সুবিধায় ইন্ডাস্ট্রিয়াল কাঁচামাল আমদানি হয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠানে পাওয়া গেল বন্ড সুবিধার কমার্শিয়াল পণ্য। অভিযোগ রয়েছে, প্রতিষ্ঠানটি বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করা চোরাই পণ্য কেনা বেচার সঙ্গে জড়িত। অবশেষে নাহিদ এন্টারপ্রাইজ নামে বন্ড সুবিধার অপব্যবহারের পণ্য কেনা-বেচায় জড়িত সেই প্রতিষ্ঠানের প্রায় ২৭৫ কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকি উদ্ঘাটন করেছে মূসক নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর (ভ্যাট গোয়েন্দা)। রাজধানীর লালবাগ এলাকার প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ভ্যাট ফাঁকির মামলা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ভ্যাট গোয়েন্দার মহাপরিচালক ড. মইনুল খান।

ড. মইনুল খান জানান, ভ্যাট গোয়েন্দা অধিদপ্তর রাজধানীর লালবাগের একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক কার্যক্রম তদন্ত করে বন্ড সুবিধার অপব্যবহারের মালামাল খোলা বাজারে বিক্রি করার অভিযোগ করে প্রায় ২৭৫ কোটি ৩২  লাখ টাকার ভ্যাট ফাঁকি উদ্ঘাটনন করেছে। একইসঙ্গে চোরাচালান ও শুল্ক ফাঁকি সংক্রান্ত মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ও আয়কর ফাঁকির অভিযোগ তদন্তের জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ভ্যাট ফাঁকির প্রমাণ পাওয়ায় প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ভ্যাট আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে।

তিনি জানান, নাহিদ এন্টারপ্রাইজ, ৩৬-৩৭ উমেশ দত্ত রোড, বকশি বাজার, লালবাগ, ঢাকা-১২১১ এলাকায় অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটি। মূসক নিবন্ধন: ০০০৩৮১০৯২-০২০৪। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্ত্বাধিকারী আলহাজ্ব আনোয়ার হোসেন। তদন্তে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ভ্যাট ফাঁকির একটি গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ভ্যাট গোয়েন্দা দপ্তরের অনুসন্ধান কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পরবর্তীতে এই অনুসন্ধানের প্রয়োজনে প্রতিষ্ঠানটির ২০১৫ সালের জুলাই হতে ২০২০ সালের জুন সময়ের ভ্যাট সংক্রান্ত দলিলাদি চেয়ে কয়েকবার চিঠি দেয়া হয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ এই অনুসন্ধানের জন্য দলিলাদি প্রেরণ না করে চিঠি দিয়ে বারবার সময়ে চেয়ে কালক্ষেপণ করে। প্রতিষ্ঠানটি দলিলাদি দাখিল করে তদন্ত কাজে সহযোগিতা না করায় চলতি বছরের ১৭ জুন ভ্যাট গোয়ন্দার উপ-পরিচালক তানভীর আহমেদ এর নেতৃত্বে নিবারক কার্যক্রম চালিয়ে প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট সংক্রান্ত বাণিজ্যিক দলিলাদি জব্দ করা হয়।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মেসার্স নাহিদ এন্টারপ্রাইজ অন্যান্য বন্ডেড প্রতিষ্ঠান থেকেও বন্ড সুবিধার অপব্যবহারের পণ্য কেনা বেচার সঙ্গে জড়িত ছিল। এর ফলে চোরাচালান ও শুল্ক ফাঁকি সংশ্লিষ্ট মানিলন্ডারিং অপরাধ সংঘটিত হয়েছে মর্মে অনুসন্ধান টিমের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানে ভ্যাট গোয়েন্দার অভিযানে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটি মূসক-৬.৩ চালান ব্যতীত সেবা প্রদান করে যথাযথ রাজস্ব পরিশোধ না করে প্রকৃত বিক্রয় তথ্য অন্যত্র গোপন দলিলে সংরক্ষণ করে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে সরকারের আর্থিক ক্ষতি সাধন করেছে।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মেসার্স নাহিদ এন্টারপ্রাইজ অন্যান্য বন্ডেড প্রতিষ্ঠান থেকেও বন্ড সুবিধার অপব্যবহারের পণ্য কেনা বেচার সঙ্গে জড়িত ছিল। এর ফলে চোরাচালান ও শুল্ক ফাঁকি সংশ্লিষ্ট মানিলন্ডারিং অপরাধ সংঘটিত হয়েছে মর্মে অনুসন্ধান টিমের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানে ভ্যাট গোয়েন্দার অভিযানে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটি মূসক-৬.৩ চালান ব্যতীত সেবা প্রদান করে যথাযথ রাজস্ব পরিশোধ না করে প্রকৃত বিক্রয় তথ্য অন্যত্র গোপন দলিলে সংরক্ষণ করে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে সরকারের আর্থিক ক্ষতি সাধন করেছে।

তদন্তে ২০১৬ সালের থেকে চলতি বছরের মে পর্যন্ত প্রায় ৫ বছর প্রতিষ্ঠানটি দাখিলপত্রে বিক্রয়মূল্য প্রদর্শন করেছে ২৯১ কোটি ৮৯ লাখ ৬৬ টাকা। কিন্তু জব্দ করা দলিলাদির ভিত্তিতে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটির প্রকৃত বিক্রয়মূল্য ছিলো এক হাজার ৫৪০ কোটি ২৬ লাখ ৬৩ হাজার ২২ টাকা। যার মধ্যে মূসক আরোপযোগ্য বিক্রয়মূল্য ছিলো এক হাজার ৩৩৯ কোটি ৩৬ লাখ ২০ হাজার ১৯ টাকা। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটি এক হাজার ৪৭ কোটি ৪৭ লাখ ১৯ হাজার ৯৫৪ টাকার প্রকৃত বিক্রয়মূল্য গোপন করেছে। বিক্রয়মূল্য কম প্রদর্শন করায় অপরিশোধিত ভ্যাট বাবদ ১৫৭ কোটি ১২ লাখ ৭ হাজার ৯৯৩ টাকা উদ্ঘাটিত হয়েছে। যার উপর মাস ভিত্তিক ২ শতাংশ হারে ১১৮ কোটি ১৯ লাখ ৯৪ হাজার ২৪২ টাকা সুদসহ মোট ভ্যাট ফাঁকির পরিমাণ ২৭৫ কোটি ৩২ লাখ ২ হাজার ২৩৫ টাকা।

মইনুল খান জানান, এখানে উল্লেখ্য যে, এই প্রতিষ্ঠানটি ৫ বছরে দাখিলপত্রের মাধ্যমে মোট ভ্যাট পরিশোধ করেছে ৪৩ কোটি ৭৮ লাখ ৩৫ হাজার ১০ টাকা। কিন্তু ভ্যাট গোয়েন্দার তদন্তে একই সময়ে ভ্যাট ফাঁকির পরিমাণ পাওয়া যায় প্রায় ১৫৭ কোটি ১২ লাখ টাকা। এই বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকি হওয়ায় স্পষ্ট হয় যে, প্রতিষ্ঠানটি নানা ধরণের অবৈধ লেনদেনের সাথে জড়িত হয়েছে। এই তদন্তে প্রতিষ্ঠানের দুটো ব্যাংক হিসাবে মোটে এক হাজার ৫৪০ কোটি ২৬ লাখ ৬৩ হাজার ২২ টাকার লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। অবৈধ বন্ডেড পণ্য কেনা বেচার অর্থ এইসব লেনদেনে সংঘটিত হয়েছে মর্মে তদন্তে উঠে এসেছে। প্রতিষ্ঠানের নামে প্রাইম ব্যাংক এর মৌলভীবাজার শাখা ও  উত্তরা ব্যাংক এর চকবাজার শাখায় দুটো ব্যাংক হিসাব রয়েছে।

মহাপরিচালক আরো জানান, বন্ড সুবিধার অপব্যবহারের পণ্য যথাযথভাবে ঘোষণা না দিয়ে খোলাবাজারে কেনা বেচা করা ভ্যাট ও কাস্টমস আইন অনুসারে অপরাধ। ভ্যাট আইনের পাশাপাশি কাস্টমস আইনের অপরাধ যথাযথভাবে তদন্ত ও প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নিতে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর এখতিয়ার সম্পন্ন হওয়ায় শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরকে তদন্তের জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। একইসঙ্গে ভ্যাট গোয়েন্দার অনুসন্ধানে প্রাপ্ত ভ্যাট ফাঁকির সংশ্লেষে আয়কর ফাঁকির অভিযোগটি আরো গভীরভাবে তদন্ত ও ব্যবস্থা নেয়ার জন্য এনবিআরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেলকে (সিআইসি) তদন্তের জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।

মইনুল খান জানিয়েছেন, তদন্তে উদ্ঘাটিত ভ্যাট দেয়া ভ্যাট আদায়ের আইনানুগ পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণের লক্ষ্যে মামলাটি সংশ্লিষ্ট ভ্যাট কমিশনারেটে পাঠানো হয়েছে। একইসঙ্গে প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম আরো মনিটরিং করার জন্যও সংশ্লিষ্ট ভ্যাট কমিশনারকে অনুরোধ করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির বন্ড সুবিধার অপব্যবহার রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার জন্য ঢাকা বন্ড কমিশনারকেও অনুরোধ করা হয়েছে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০