শেয়ার বিজ ডেস্ক:প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাব, আর্থিক সমস্যা ও নানা সংকটে বন্ধ হওয়ার পথে ফেনীর ফুলগাজী উপজেলার তাঁতশিল্পের খাদি প্রতিষ্ঠান ও গান্ধী আশ্রম ট্রাস্ট। একসময় এখানকার হস্তচালিত তাঁত চরকার মাধ্যমে উৎপাদিত কাপড়ের খ্যাতি দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়লেও ধীরে ধীরে স্থবির হয়ে পড়েছে এই প্রাচীন প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম।
জানা গেছে, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে তৎকালীন সময়ে পাক-ভারত উপমহাদেশে হস্তচালিত কাঠের তৈরি চরকা দিয়ে শুরু হয় তাঁতশিল্প। ১৯২১ সালে ভিন দেশে তৈরি কাপড় বর্জনের ডাক দিয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধী। তারই অংশ হিসেবে ১৯২১ সালের ৩১ আগস্ট ফুলগাজী উপজেলার নতুন মুন্সীরহাট (তৎকালীন বীরচন্দ্র) বাজারের পাশে ১০৬ শতক জায়গায় গড়ে উঠেছিল খাদি প্রতিষ্ঠান ও গান্ধী আশ্রম ট্রাস্ট, যা উদ্বোধন করেছিলেন মহাত্মা গান্ধী নিজেই। পরে এই তাঁতশিল্পকে ঘিরেই ওই এলাকায় তাঁতিদের বসবাস শুরু হয়। তবে বর্তমানে অটো পাওয়ার মেশিনে কাপড় তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর কাঁচামাল সুতা ও রং দেয়ার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না থাকায় বন্ধ হওয়ার পথে প্রাচীন এ তাঁতশিল্পটি।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, তাঁতশিল্প প্রকল্পের আওতায় একটি চরকায় তিন নারী শ্রমিক এবং সঞ্চয় ও ঋণ প্রকল্পের আওতায় চার পুরুষ ও নারী কাজ করছেন। দৈনিক তৈরি পণ্যের ওপর মজুরি দেয়া হয় শ্রমিকদের। এ ছাড়া দুপুরে খাবার বাবদ প্রত্যেকে ৫০ টাকা করে পান। অথচ ট্রাস্ট উদ্বোধনের প্রথম দিকে কথা ছিল ২০ নারী শ্রমিক ৮টি তাঁত ও ১২টি চরকায় কাজ করবে। পরে তা বৃদ্ধি পাওয়ার কথা থাকলেও বন্ধের পথে এ শিল্পটি।
ট্রাস্টের আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক প্রফুল্ল চন্দ্র ভৌমিক বলেন, প্রাথমিক অবস্থায় ১২টি হস্তচালিত তাঁত যন্ত্রের মাধ্যমে কাপড় তৈরি হতো। এখানকার তাঁতশিল্পকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল বাজার। পরে এই বাজারের নামকরণ করা হয় নতুন মুন্সিরহাট বাজার। ১৯৪৮ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই তাঁতশিল্পটি বন্ধ হয়ে যায়। তখন সচল হস্তচালিত তাঁতযন্ত্র নষ্ট হয়ে যায়। দেশভাগের পর নতুন করে নোয়াখালী গান্ধী আশ্রম ট্রাস্ট প্রধান কার্যালয় থেকে সহযোগিতা নিয়ে চালু করা হয় হস্তচালিত তাঁতশিল্পটি। সর্বশেষ ২০১৩ সালে ভারতের উপরাষ্ট্রদূত বাবু সন্দীপ চক্রবর্তী আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে এখানে আটটি তাঁতযন্ত্রের মাধ্যমে শিল্পটির কার্যক্রম শুরু করেন।
এদিকে কার্যক্রম সীমিত হওয়ায় উপজেলার অনেক গ্রামীণ নারী শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন। তাঁত প্রকল্পের বিভিন্ন কাঁচামাল সরবরাহ না থাকায় চরকাগুলো দীর্ঘদিন বন্ধ রয়েছে। এতে তাঁতকলের যন্ত্রপাতি বিকল হয়ে পড়েছে। বন্ধ রয়েছে নতুন করে শ্রমিক নিয়োগ কার্যক্রমও। বর্তমানে একটি চরকাতে কাজ চললেও সেখানে কয়েকটি গামছা ও রুমাল ব্যতীত অন্যকিছু তৈরি হয় না।
আশ্রমে কর্মরত শ্রমিক শাহেনা আক্তার বলেন, এখানে মজুরি একদম কম। তারপরও নিরুপায় হয়ে পেটের দায়ে কাজ করছি। একটি গামছা তৈরি করে ৪০ টাকা ও রুমাল তৈরি করে ১০ টাকা পাই। দিনে সর্বোচ্চ দুটি গামছা তৈরি করতে পারি। এভাবে আর চলা যায় না।
ছকিনা আক্তার নামে আরেক শ্রমিক বলেন, আমরা মানবেতর জীবনযাপন করছি। কখনও কোনো সহযোগিতা পাই না। কেউ খোঁজ নিতেও আসেন না। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যদি একটু নজর দেয়, তাহলে এখানে কাজ করে পরিবার নিয়ে আমরা কিছুটা স্বস্তিতে থাকতে পারব।
ট্রাস্টের আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক প্রফুল্ল চন্দ্র ভৌমিক বলেন, করোনাকালে বন্ধ থাকায় শ্রমিকরা পেশা পরিবর্তন করেছে। এ ছাড়া কাজটি অনেক কষ্টকর হওয়ায় শ্রমিকরা বেশি সময় কাজ করতে পারেন না। খুব শিগগিরই আশ্রমটিতে আধুনিকায়নের মাধ্যমে ঐতিহ্য ধরে রেখে বড় পরিসরে কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। চলতি মাসে নোয়াখালীতে ট্রাস্টি বোর্ডের একটি সভা হওয়ার কথা রয়েছে। সেখানে এই প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে উল্লেখযোগ্য একটি সিদ্ধান্ত আসতে পারে।
এ ব্যাপারে নবনির্বাচিত ফুলগাজী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হারুন মজুমদার বলেন, প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘদিন ধরে নাজুক অবস্থায় পড়ে থাকলেও কোনো জনপ্রতিনিধি এগিয়ে আসেননি। শপথ গ্রহণের পরপরই স্থানীয় সংসদ সদস্য আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিমের সঙ্গে কথা বলে আবার নতুন রূপে কার্যক্রম শুরু করতে কাজ করব। আশা করি, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় আগামী পাঁচ-ছয় মাসের মধ্যে এটি আলোর মুখ দেখবে।
একই প্রসঙ্গে ফুলগাজী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তানিয়া ভূঁইয়া বলেন, গান্ধী আশ্রম ট্রাস্টের বিষয়ে কেউ কখনও আমার কাছে আসেনি। কয়েক দিন আগেই এ প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে অবগত হয়েছি। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে তাদের সর্বোচ্চ সহযোগিতা করব।