ডলার সংকট বেড়েই চলেছে। এতে শিল্পপণ্যের কাঁচামাল আমদানিতে এলসি খোলা যাচ্ছে না। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিল্প উৎপাদন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নিত্যপণ্যের আমদানিতে ডলার সংকট। জ্বালানি তেল ও বিদ্যুৎ আমদানিতেও ডলার দিতে পারছে না ব্যাংকগুলো। এ নিয়ে শেয়ার বিজের ধারাবাহিক আয়োজনের আজ ছাপা হচ্ছে প্রথম পর্ব
ইসমাইল আলী: কয়েক মাসের ব্যবধানে দেশে ডলার সংকট চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিভিন্ন ব্যাংক শিল্পের কাঁচামাল আমদানির এলসি খুলতে পারছে না। এর সঙ্গে নতুন যুক্ত হয়েছে চাল, সার, ছোলা, জ্বালানি তেলসহ জরুরি পণ্য আমদানি। এসব খাতে ১১ সংস্থার চাহিদা ২৬৯.৫৩৮ মিলিয়ন ডলার। তবে সোনালী ব্যাংকে আছে মাত্র ১১.২৬৭ মিলিয়ন ডলার। ফলে ডলার সংকটে অগ্রাধিকার খাতভুক্ত এসব পণ্য আমদানি বন্ধ হতে যাচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, পর্যাপ্ত ডলার না থাকায় জরুরি ভিত্তিতে ২৪৮ মিলিয়ন ডলার চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের দ্বারস্থ হয় রাষ্ট্রায়ত্ত সর্ববৃহৎ ব্যাংকটি। গত ৯ জানুয়ারি এ চিঠি দেয়া হয়, যার প্রতিলিপি শেয়ার বিজের কাছে এসে পৌঁছেছে। এতে ১১টি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার ডলার চাহিদার বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ইতিবাচক কোনো সাড়া পায়নি সোনালী ব্যাংক। এতে প্রয়োজনীয় পেমেন্ট দিতে পারছে না ব্যাংকটি।
বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, ৯ জানুয়ারি রপ্তানি আয়, রেমিট্যান্স ও সোয়াপ (ক্রয়-বিক্রয়) মিলিয়ে সোনালী ব্যাংকের কাছে ডলার মজুত ছিল ১০.১৫১ মিলিয়ন ডলার। এছাড়া ব্যাংকটির নস্ট্র হিসাবে রয়েছে আরও ব্যবহারযোগ্য ১.১১৬ মিলিয়ন ডলার। চাহিদা মেটাতে বিভিন্ন উৎস থেকে ডলার সংগ্রহের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে তারা। তাই চাহিদা মেটাতে ১২৪ মিলিয়ন ডলার নগদ সরবরাহ এবং ১২৪ মিলিয়ন ডলার ব্যাংকটির নস্ট্র হিসাবে জমা (ক্রেডিট) করতে বলা হয়।
চিঠিটি বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত ৯ জানুয়ারি সোনালী ব্যাংকের চাহিদার মধ্যে খাদ্য অধিদপ্তরের চাল আমদানিতে ১২.২৫৪ মিলিয়ন ডলার দরকার ছিল। ব্যাংক অব চায়নাকে এ বিল পরিশোধ করতে হবে। বিপিসির জ্বালানি তেল আমদানিতে ২৯.৪৭৩ মিলিয়ন দরকার, যা এরই মধ্যে ডেফার্ড হয়েছে। সিটি ব্যাংক এনএ’র নিউইয়র্ক শাখার বরাবর এ বিল পরিশোধ করতে হবে। সার আমদানিতে দুই সংস্থার ডলার দরকার। এর মধ্যে বিসিআইসির (বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন) তিনটি বিলে দরকার ২.২৯৩ মিলিয়ন ডলার এবং বিএডিসির (বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন) তিনটি বিলে দরকার ২.০৩৭ মিলিয়ন ডলার। এসব বিলের চারটি যাবে সিটি ব্যাংক এনএ’র নিউইয়র্ক শাখায় এবং দুটি যাবে দুবাইভিত্তিক মাশরেক ব্যাংকে।
জরুরি চাহিদার মধ্যে দুটি খাত ছিল পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র সংশ্লিষ্ট। এর মধ্যে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লা আমদানিতে তিনটি বিলে ১২৬.৮১৬ মিলিয়ন এবং কয়লা পরিবহনের জাহাজ ভাড়া পরিশোধে পাঁচটি বিলে ৪.২৬৩ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হবে। টিসিবির ছোলা আমদানিতে তিনটি বিলে দরকার ১.৩৬২ মিলিয়ন ডলার। সব বিলই পরিশোধ করতে হবে সিটি ব্যাংক এনএ’র নিউইয়র্ক শাখায়। আর পিডিবির (বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড) রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের তিনটি বিল পরিশোধে দরকার ১১.০৯৬ মিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে দুটি বিল যাবে দুবাইভিত্তিক মাশরেক ব্যাংকে ও একটি যাবে ভারতের ব্যাংক অব কেলকাটায়।
এর বাইরে প্রতিরক্ষা ক্রয় মহাপরিদপ্তরের হালকা ট্যাঙ্ক কেনার বিল বাবদ দুটি বিলে পরিশোধ করতে হবে ৬৫.৯৬৪ মিলিয়ন ডলার। আর বাংলাদেশ সাবমেরিন কেব্ল কোম্পানি লিমিটেডের (বিএসসিসিএল) নির্মাণ ব্যয় বাবদ ২.৬৮ মিলিয়ন ডলার দরকার ছিল। এ ছাড়া ইস্টার্ন রিফাইনারির সেবাপণ্য বাবদ ৪.৩০ মিলিয়ন ও বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের একই খাতে সাত মিলিয়ন ডলার দরকার। এর মধ্যে শুধু বিমানের বিলটি পরিশোধ করতে হবে জেপি মরগ্যান ব্যাংকে। বাকিগুলো সিটি ব্যাংক এনএ’র নিউইয়র্ক শাখায় পরিশোধ করতে হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৯ জানুয়ারি ডলার চেয়ে চিঠি দিলেও তা না পাওয়ায় এখনও কোনো বিলই পরিশোধ করতে পারেনি সোনালী ব্যাংক। এ বিষয়ে জানতে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আফজাল করিম এবং উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক সুভাষ চন্দ্র দাসের সঙ্গে মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তারা কল রিসিভ করেননি। পরে ম্যাসেজ দেয়া হলেও তার উত্তর দেননি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে সোনালী ব্যাংককে ডলার সহায়তা দেয়া হচ্ছে না কেনÑজানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হকও কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে শেয়ার বিজকে বলেন, এত বড় অঙ্কের ডলার সহায়তা দেয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে সম্ভব নয়।
যদিও গত রোববার মুদ্রানীতি ঘোষণার সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, নিত্যপণ্যের আমদানিতে এলসি খুলতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেয়া আছে। রমজানে এ নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না।
এদিকে বর্তমানে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রে মাত্র ১৫ দিনের মতো কয়লা মজুত আছে। আগের পেমেন্ট না দেয়ায় কয়লা আমদানির এলসি খুলছে না বিদ্যুৎকেন্দ্রটির চায়না সহযোগী সিএমসি। যদিও পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লা আমদানির একটি বিল ১৮ বার ডেফার্ড (বিলম্বিত) করেছে সোনালী ব্যাংক। আবার জাহাজ ভাড়া পরিশোধ না করায় বিদ্যুৎকেন্দ্রটির কয়লা খালাস আটকে আছে। এতে ডেমারেজ দিতে হচ্ছে প্রতিদিন প্রায় ৭০ হাজার ডলার। এছাড়া কয়লা ডলার সংকটে কয়লা আমদানি করতে না পেরে বন্ধ হয়ে গেছে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র।