সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: গত কয়েক বছর ধরে ব্যবসা পরিচালনায় বহুমাত্রিক সমস্যা মোকাবিলা করছে ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড। প্রতিষ্ঠানটিতে চলতি মূলধন সংকট, নতুন করে অর্ডার না পাওয়ার পাশাপাশি চলমান প্রকল্পগুলোর কাজও খুবই ধীরগতি এগোচ্ছে। পাশাপাশি শ্রমিক অসন্তোষও লেগেছে আছে। এসব কারণে গত আড়াই মাস ধরে কার্যত বন্ধ হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির কারখানা।
যদিও এর কয়েক মাস আগে থেকে শ্রমিক ও কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা বকেয়া পড়ে আছে। আর দেশে করোনা সংক্রমণের আগেই নিরাপদে থাকার জন্য কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোহেল হাসান সিঙ্গাপুরে পাড়ি জমান। পাশাপাশি পরিচালনা পর্ষদের একাধিক সদস্যদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও সম্পর্কের ফাটল ধরেছে। একে পুরোপুরি স্থবির হয়ে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটির বাণিজ্যিক কার্যক্রম। আর করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি আরও কয়েক মাস প্রলম্বিত হলে প্রতিষ্ঠান স্থায়ীভাবে বন্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে পড়তে পারেÑএমন আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, বাংলাদেশের রপ্তানিমুখী জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এক সময় শীর্ষে ছিল ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির ২০০০ সালে যাত্রা শুরু হলেও পুঁজিবাজারের নিবন্ধিত হয় ২০১৪ সালে। তবে নিবন্ধিত হওয়ার আগ থেকেই প্রতিষ্ঠানটি নানা সংকটে আক্রান্ত ছিল। তখন প্রতিষ্ঠানটির মোট ঋণ ছিল ৬৪৬ কোটি টাকা। কিন্তু একই সময়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে নেওয়া হয় ৪৫ কোটি টাকা। এরপর থেকে গত ৩০ জুন ২০১৯ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে নেওয়া আরও প্রায় ৬৪৮ কোটি টাকা ঋণ।
এ বিপুল পরিমাণে পুঁজি সংগ্রহের পরও প্রতিষ্ঠান কোনো কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি তালিকায় নাম উঠে আসে। এছাড়া চেক প্রত্যাখ্যানের মামলা হয়, পাওনাদারের পাওনা পরিশোধে একাধিকবার ব্যর্থতা, নগদ প্রবাহে সংকট, প্রকল্প কাজে ধীরগতি, নতুন করে অর্ডার না পাওয়া, শ্রমিক অসন্তোষ ইত্যাদি দেখা দেয়। এমনকি পাওনাদারদের সহজে দেখা না দেওয়ার জন্য মাঝে একবার অফিসও পরিবর্তন করে প্রতিষ্ঠানটি। আর এসব কারণে পরিচালকরা আস্থা রাখতে পারেননি ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ ব্যবস্থাপনা কমিটির ওপর। ফলে পরিচালকরা সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালকের অধিকাংশ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাতেন না। পাশাপাশি এসব বিষয়ে নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করত।
এসব কারণে পর্ষদের একাধিক সদস্যদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও সম্পর্কের ফাটল ধরে। ফলে এক পক্ষ গত বছরের ১৮ জুন সাখাওয়াত হোসেনকে অপ্রত্যাশিতভাবে ব্যবস্থাপনা পরিচালক থেকে সরিয়ে দেয়। আর দায়িত্ব দেওয়া হয় অনভিজ্ঞ ক্যাপ্টেন সোহেল হাসানকে। এছাড়া ওয়েস্টার্ন মেরিনের চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম একাধিকবার প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার ছেড়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। তবে প্রতিবারই তাকে অনুরোধ করে রাখা হয়। আরও কয়েকজন পরিচালক পর্ষদ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য চেষ্টা করেছেন।
এদিকে সম্পর্ক বিনষ্ট ও নিয়মিত বেতন-ভাতা পরিশোধে ব্যর্থতায় কোম্পানির অর্থ উপদেষ্টা অরুপ চৌধুরী, প্রধান অর্থ কর্মকর্তা জামাল উদ্দিন, সচিব সাহাদাত হোসেন চাকরি ছেড়ে নিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন। যদিও কোম্পানির অর্থ উপদেষ্টা অরুপ চৌধুরী আবার ফিরে আসেন। তবে তিনি একাধিকবার চাকরি ছেড়েন আবার যোগদান করেন।
কর্মরত শ্রমিক সূত্রে জানা যায়, গত ২৬ মার্চ থেকে শিপইয়ার্ড বন্ধ। সিকিউরিটি গার্ড ছাড়া মালিক পক্ষের কেউ নেই। গত ডিসেম্বর থেকে বেতন দেওয়া হচ্ছে না। প্রতিষ্ঠানটির ৪০০ শ্রমিক আছে। তবে গত চার মাস ধরে তাদের বেতন বন্ধ। এছাড়া গত ১৭ মাস ধরে শ্রমিকদের ওভারটাইম পরিশোধ করেনি কর্তৃপক্ষ। আর করোনা সংক্রমণের আগে অনেকটা গোপনে সিঙ্গাপুরে চলে যান ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্যাপ্টেন সোহেল হাসান। মালিক পক্ষকে না পেয়ে শ্রমিকরা গত ১৯ এপ্রিল কারখানার গেটে বিক্ষোভ করেন।
প্রতিষ্ঠানটির সাবেক কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, ওয়েস্টার্ন মেরিনের পরিচালনা পর্ষদে যোগ্য নেতৃত্ব না থাকায় গত কয়েক বছর ধরে বহুমুখী সমস্যায় আছে। কারখানা সম্প্রসারণ হওয়ার সময় অতিরিক্ত খরচ, প্রয়োজনের অতিরিক্ত ঋণ গ্রহণ, অধিক দামে যন্ত্রপাতি ক্রয়, প্রয়োজনের অতিরিক্ত স্টক মজুদ ইত্যাদি ঘটনা ঘটে। আর নিরীক্ষা প্রতিবেদনেরও অনেক সময় সঠিক তথ্য দেওয়া হয় না। এছাড়া অভিযোগ রয়েছে, বর্তমান এমডি (সোহেল হাসান) নিজে সিঙ্গাপুরের কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে যন্ত্রপাতি সরবরাহে অতিরিক্ত অর্থ হাতিয়ে নেন। আর প্রাতিষ্ঠানিক অদক্ষতায় ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের ব্যবসাও মন্দার ছোঁয়া লাগে। ফলে ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকে ব্যাংক দায়ের পরিমাণ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমি একজন পরিচালক হিসেবে বলতে পারি এখন প্রতিষ্ঠানের কিছু কিছু পরিচালকের মধ্যে দ্বন্দ্ব, দূরত্ব আছে। তারা সুযোগ খুঁজছেন কীভাবে বেরিয়ে আসা যায়। স্বয়ং চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম সাহেব তো খুবই বিরক্ত। তিনি বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছেন বের হয়ে যাবেন। কিন্তু অনুরোধ করে রাখা হয়। শুনছি রাইট শেয়ার অনুমোদন হলে তিনি বের হয়ে যাবেন। এ প্রতিষ্ঠানের সাধারণ বিনিয়োগকারীর সংখ্যা বেশি। যেহেতু বোর্ডে আমাদের মূল্যায়ন নেই, সেহেতু আমি, আমরা নিজের প্রতিষ্ঠান নিয়ে এখন চিন্তা-ভাবনা ও কাজ করছি। এছাড়া এ প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমার কিছু করার সুযোগ নেই। এখন নতুন এমডিসহ প্রভাবশালী পরিচালকরা চিন্তা-ভাবনা করবেন। তারাই ভালো জানেন কোম্পানির ভবিষ্যৎ কী হবে।’
এ বিষয়ে জানতে ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড লিমিটেডের চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলামের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করলে তিনি মুঠোফোন রিসিভ করেননি। এছাড়া ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোহেল হাসানের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে ব্যবহƒত নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়। একইভাবে উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবদুল মুবিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি মুঠোফোনে সাড়া দেননি।
পরে কোম্পানিটির অর্থ উপদেষ্টা অরুপ চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমাদের এমডি সিঙ্গাপুরে। আমরা নিজেরাই গত কয়েক মাস বেতন-ভাতা পাচ্ছি না। আর শিপইয়ার্ডে কাজও বন্ধ আছে। করোনার এ কঠিন সময়ে কারও বেতন হচ্ছে না। আমরা অনেক কঠিন সময় পার করছি। এ পরিস্থিতি কবে ভালো হবে, তা বুঝা যাচ্ছে না।’

Print Date & Time : 23 June 2025 Monday 12:26 pm
বন্ধ হওয়ার পথে ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড!
দিনের খবর,প্রথম পাতা ♦ প্রকাশ: