শিপইয়ার্ড থেকে স্ক্র্যাপ বিক্রি বন্ধের সিদ্ধান্ত

বন্ধ হতে পারে ইস্পাত কারখানা টনে কমেছে সাত হাজার টাকা

সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: দেশের ইস্পাত খাতের প্রধান কাঁচামালের জোগান আসে শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড থেকে। কয়েক মাস ধরে দেশের বাজারে কমতে থাকে স্ক্র্যাপের দাম। গত কয়েক দিনে কমে আসে টনপ্রতি সাত হাজার টাকা। আন্তর্জাতিক বাজারের দাম নিম্নমুখী হওয়ায় এবং অভ্যন্তরীণ বাজারে চাহিদা না থাকায় ফের দাম কমার আশঙ্কা প্রকাশ করছেন স্ক্র্যাপ ব্যবসায়ীরা। মাত্রাতিরিক্ত লোকসানের আশঙ্কায় শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড থেকে স্ক্র্যাপ বিক্রি অঘোষিতভাবে বন্ধ করে দেন ব্যবসায়ীরা। এতে চাহিদা অনুসারে সরবরাহ না পেলে ইস্পাত উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যাবে।
বাংলাদেশ শিপ ব্রেকিং অ্যান্ড রিসাইক্লিং অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে পুরোনো জাহাজের দরপতন, অভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদা কম এবং ট্যাক্স জটিলতার কারণে দেশের কালো স্বর্ণের খনি-খ্যাত শিপ ব্রেকিং সেক্টর সংকটে পড়ে। এ নাজুক অবস্থার কারণে সম্প্রতি সমিতির সদস্যদের এক জরুরি সভায় সাময়িকভাবে স্ক্র্যাপ বিক্রি বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়।
এ খাতের সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা জানান, স্বাভাবিক সময়ে প্রতি মাসে গড়ে ২০-২৫টি পর্যন্ত পুরোনো জাহাজ আনা হতো। চলতি মাসে তিনটি জাহাজও আসেনি। আর গত তিন মাসে কাটার জন্য ১০টিও জাহাজ আনা হয়নি। হঠাৎ করে দাম কমার কারণে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে স্ক্র্যাপের দাম কমে যাওয়ায় জাহাজ কাটায় ১০-২০ কোটি টাকা পর্যন্ত লোকসান গুনতে হচ্ছে। অপরদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে স্ক্র্যাপের দাম কমে যাওয়ায় স্থানীয় ইস্পাত কারখানাগুলো শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড থেকে না কিনে সরাসরি বিদেশ থেকে স্ক্র্যাপ আমদানি করছে। এতে কারখানাগুলোর খরচ কম হলেও ইয়ার্ড মালিকরা লোকসানে পড়েন।
এছাড়া চলতি বাজেটে নতুনভাবে ইয়ার্ড থেকে প্রতিটন স্ক্র্যাপ বিক্রির ওপর এক হাজার টাকা করে লোকাল ট্যাক্স আরোপ করা হয়েছে। অথচ ইয়ার্ডগুলোতে আগে আমদানি করা জাহাজের স্ক্র্যাপ রয়েছে। আর যখন আমদানি করা হয়েছিল তখন প্রচলিত সব ধরনের রাজস্ব পরিশোধ করা হয়েছিল। সব মিলিয়ে এ খাতে সংকট প্রকট হচ্ছে।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের সূত্রে, বিদায়ী অর্থবছর (২০১৮-১৯) এবং গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরের চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস দিয়ে দেশের স্ক্র্যাপ জাহাজ ব্যবসায়ীরা ৪৬৪টি পুরোনো জাহাজ আমদানি করেছিলেন। ১০০টি প্রতিষ্ঠানের আমদানিকৃত জাহাজের মোট ব্যয় ছিল প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। এসব জাহাজ আমদানির বিপরীতে ৮৩৩ কোটি টাকা রাজস্ব আহরণ করে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস।
এ বিষয়ে একাধিক ইস্পাত উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের পরিচালকরা বলেন, হঠাৎ করে ইয়ার্ড মালিকরা স্ক্র্যাপ বিক্রি বন্ধ ঘোষণা দেন। এটা কাম্য নয়। ব্যবসায় তো সব সময় লাভ থাকবে, এমন কথা নেই। এক সময় লোকসানও হবে। এটাই তো ব্যবসায়ের নিয়ম। ছোট-বড় সব ধরনের ইস্পাত উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। হয়তো এখন কিছু স্ক্র্যাপ মজুত আছে। তা দিয়ে তো আর বেশিদিন উৎপাদন কার্যক্রম সচল রাখা যাবে না। এছাড়া যাদের বিদেশ থেকে আমদানির সুযোগ আছে, তারা তো উৎপাদন চালিয়ে যেতে পারবে। কিংবা যাদের নিজস্ব স্ক্র্যাপ ইয়ার্ড আছে, তারা উৎপাদন সচল রাখতে পারবে।
এ বিষয়ে দেশের শীর্ষ পুরোনো জাহাজ আমদানিকারক ও ইস্পাত উৎপাদনকারী মোস্তফা হাকিম গ্রুপের পরিচালক সারোয়ার আলম শেয়ার বিজকে বলেন, গত কয়েক দিনের ব্যবধানে টনপ্রতি স্ক্র্যাপের মূল্য কমেছে সাত হাজার টাকা করে। এখন প্রতি টন স্ক্র্যাপের দাম ২৯ হাজার টাকা, যা আগে ছিল ৩৬ হাজার টাকা।
সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে পুরোনো জাহাজের দরপতন, অভ্যন্তরীণ বাজারে চাহিদা হ্রাস এবং ট্যাক্স জটিলতার করণে দেশের শিপ ব্রেকিং সেক্টর সংকটে পড়ে। এছাড়া চলতি বাজেটে ইয়ার্ড থেকে বিক্রির সময় টনপ্রতি এক হাজার টাকা লোকাল ট্যাক্স আরোপ করা হয়। সব মিলিয়ে এ খাতের এমন পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। আর এ সংকট থেকে উত্তরণের জন্য ইয়ার্ড থেকে স্ক্র্যাপ বিক্রি বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়, যা ইয়ার্ড মালিকদের বৈঠকে চূড়ান্ত হয়।
একই বিষয়ে মিডল্যান্ড ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান ও ম্যাক করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাস্টার আবুল কাশেম শেয়ার বিজকে বলেন, ব্যাহত দরপতনের কারণে মেলটিং স্ক্র্যাপ অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়। এ অবস্থায় আমাদেরও দেউলিয়া হতে হবে। আগে অনেক ব্যবসায়ী ঋণখেলাপি হয়ে শেষ হয়েছেন। তবে বিলেট সরবরাহ স্বাভাবিক আছে। আর স্ক্র্যাপ সরবরাহ না থাকলেও তো অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, কাঁচামাল সরবরাহ বন্ধ হলে তো কারখানা বন্ধ হবে। এটা তো স্বাভাবিক। এখানে তো আমাদের কিছু করার নেই। চলতি অর্থবছরের বাজেটেও লোকাল ট্যাক্স আরোপ করা হয়। সব মিলিয়ে শিপ ব্রেকিং সেক্টরে সংকট চলছে।
উল্লেখ্য, ষাটের দশকে সীতাকুণ্ড উপজেলার ফৌজদারহাট থেকে বারো আউলিয়া পর্যন্ত দীর্ঘ ২০ কিলোমিটার এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে জাহাজভাঙা শিল্প। এ অঞ্চলে মোট ১৫৪টি জাহাজভাঙা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেও বর্তমানে প্রায় ১০০টি প্রতিষ্ঠান সচল। এসব প্রতিষ্ঠান রিরোলিং মিলগুলোতে স্ক্র্যাপের জোগান দেয় ৩৫-৪০ লাখ টন, যার মাধ্যমে পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে দেশের মোট ইস্পাতের চাহিদার ৮০ শতাংশই পূরণ হয়। এসব উৎপাদিত ইস্পাত ব্যবহার করা হয় সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০