প্রতিনিধি, মৌলভীবাজার : দেশের সবচেয়ে বড় হাওর হাকালুকি তীরের কুলাউড়া, জুড়ী ও বড়লেখাÑএই তিনটি উপজেলার প্রায় তিন লাখ বন্যাকবলিত মানুষ এখন চরম দুর্দশায়। মৌলভীবাজার জেলায় বন্যার ১৩ দিন চলমান। এ জেলার সাতটি উপজেলার নদ-নদীর তীরবর্তী এলাকায় বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি হলেও হাওর এলাকায় ভিন্ন রূপ। বিশেষ করে হাকালুকি হাওর তীরবর্তী এলাকায় পানি না কমায় দীর্ঘ জলাবদ্ধতায় রূপ নিচ্ছে। চরম দুর্ভোগে পড়েছেন হাকালুকি হাওরের তীরবর্তী তিন উপজেলার বানভাসি মানুষ।
বানের পানিতে ডুবে থাকা ঘরবাড়ি আর রাস্তাঘাট যখন জেগে ওঠার প্রত্যাশায় ছিলেন হাওর অঞ্চলের বাসিন্দারা, ঠিক তখনই উল্টো চিত্র দেখা দিচ্ছে। ধীরগতিতে বানের পানি কমে তা দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতায় রূপ নিচ্ছে। দিনে বা রাতে পানি কিছুটা কমলেও বৃষ্টিতে আবার যেই সেই। বন্যাকবলিত হাকালুকি হাওর তীরবর্তী এলাকার বিভিন্ন গ্রামের মানুষ তাদের খাদ্যসংকটের কথা জানিয়েছেন।
এ ছাড়া জেলার হাওর এলাকায় প্রায় ৩৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বন্যার পানি থাকায় ক্লাস চালু করা সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছেন জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মো. ফজলুর রহমান।
হাওরপাড় এলাকার বাসিন্দা আজিজুল ইসলাম, রফিক মিয়া, করিম মিয়া, আয়েশা বেগম ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘ত্রাণের জন্য রাত-দিন অপেক্ষায় থাকলেও এ পর্যন্ত সরকারি তরফে দুই ধাপে ১০ কেজি চাল ছাড়া কিছুই পাইনি। আর বেসরকারি সংস্থা ও ব্যক্তি উদ্যোগের ত্রাণ কেবল শুকনো খাবার, বিস্কুট, চিড়া, মুড়ি, গুড় পাচ্ছি; আর এসব খেয়ে আছি। বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে এভাবে কত থাকা যায়? চিন্তা করে আর কিছু পাচ্ছি না।’
সরকারি-বেসরকারি কোনো মেডিকেল টিম এখনও তাদের দেখতে যায়নি। তাই তারা পানিবাহিত নানা রোগবালাই নিয়ে জীবনযাপন করছেন। বন্যায় তাদের আয়-রোজগার নেই। তাই এখন ঘরে চাল নেই, ভাত নেই, খাবার নেই এমনকি বিশুদ্ধ পানিও নেই। নেই স্যানিটেশন সুবিধাও। বাড়িফেরা আর পুনর্বাসনের দুশ্চিন্তায় তাড়া করছে আশ্রয়কেন্দ্রে ও অন্যত্র থাকা বানভাসিদের। কিন্তু তাদের অধিকাংশ বাড়িতে এখনও কোমর থেকে হাঁটু পর্যন্ত পানি। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোয় থাকা অনেকেই জানালেন ঈদের দিনও তারা অনাহারে-অর্ধাহারে ছিলেন। আর ওই সময় যারা বাড়িতে ছিলেন তারাও রাত-দিন পার করেছেন নানা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায়।
চরম অসহায় বন্যার্ত এ মানুষগুলোর এখন দু’চোখের জল যেন তাদের সান্ত্বনার ভাষা। তাদের মতো অসহায় ওই এলাকার গৃহপালিত পশুগুলোও। খাদ্য আর বাসস্থান হারিয়ে তারাও পড়েছে চরম সংকটে। খাদ্যহীন, গৃহহীন মানুষগুলোর দুর্ভোগ আর মানবেতর জীবনযাপন এখন তাদের নিত্যসঙ্গী। বানভাসি অসহায় মানুষগুলো রাত পোহালেই ত্রাণের আশায় পথের পানে চেয়ে থাকেন। কিন্তু তারা হতাশ হচ্ছেন। কারণ, তারা দুর্দিনে পাচ্ছেন না আশানুরূপ সাহায্য। সরকারি তরফে যে সহযোগিতা আসছে তা যেমন পর্যাপ্ত নয়। আর এবারের বন্যায় ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান কিংবা বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে ত্রাণ বিতরণও হচ্ছে কম।
মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক উর্মি বিনতে সালাম জানিয়েছেন, বছরে এক হাজার ৫০ মেট্রিক টন বরাদ্দ। তার মধ্যে বন্যাকবলিত মানুষের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে ৯৩৪ মেট্রিক টন চাল আর বিভিন্ন সময়ে ৩৯ মেট্রিক টন বিতরণ করা হয়। বর্তমানে ত্রাণসামগ্রী ১১৬ মেট্রিক টন ও নগদ ২৫ হাজার টাকা মজুত আছে। নগদ সহায়তা ২০২৩-২৪ সালে অর্থবছরে মোট বরাদ্দ ৩০ লাখ টাকা। তার মধ্যে উপজেলায় উপবরাদ্দ ৭ লাখ ১২ হাজার ৫০০ টাকা আর বন্যাকবলিত উপবরাদ্দ ১২ লাখ ৬২ হাজার ৫০০ টাকা। গোখাদ্যের ক্রয়ের জন্য উপবরাদ্দ ৫ লাখ টাকা এবং শিশুখাদ্য ক্রয়ের জন্য উপবরাদ্দ ৫ লাখ টাকা।
তিনি আরও জানান, সরকারিভাবে প্রাপ্ত তিন হাজার ৫০০ প্যাকেট শুকনো খাবার আর উপজেলা প্রশাসনের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় দুই হাজার ৮০০ প্যাকেট বিতরণ করা হয়েছে। প্রতিটি আশ্রয়কেন্দ্রে বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখনও বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দেয়নি। ইতোমধ্যে ৭৫ হাজার পিস পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ও ২ হাজার ৫০০টি খাবার স্যালাইন সরবরাহ করা হয়েছে।
জেলা প্রশাসক জানান, ৯২৯ বর্গকিলোমিটার এলাকায় ৪৮টি ইউনিয়নে ৫২০টি গ্রামে বন্যায় আক্রান্ত হয়েছেন ২ লাখ ৯৩ হাজার ৩৬৯ জন। ১২৬টি আশ্রয়কেন্দ্রে লোকসংখ্যা ৭ হাজার ৪৬৮ জন এবং ৫৪টি মেডিকেল টিম কাজ করছে। আশ্রয়কেন্দ্রে গবাদিপশুর সংখ্যা ৬৬৭টি। তিনি বলেন, ‘পুরো জেলায় বন্যা পরিস্থিতির দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা হচ্ছে।’
মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী জাবেদ ইকবাল জানিয়েছেন, কুশিয়ারা, ধলাই ও মনু নদীর পানি কমলেও জুড়ী নদীর পানি বিপৎসীমার ১৬৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যার ফলে হাওর এলাকায় বন্যার পানি ধীরগতিতে নামছে।