আলাউদ্দীন শাহরিয়ার, বান্দরবান :বই হচ্ছে মনের খোড়াক। প্রত্যেকটা মানুষের জীবনেই বই অমূল্য সম্পদ। আমাদের কাছে লাইব্রেরির বইগুলো হচ্ছে নিজের সন্তানের মতো। আমরা এই লাইব্রেরিতে নিয়মিত বই পড়ি, বইগুলো যতœ করে রাখি। বন্যায় যে বইগুলো নষ্ট হয়ে গেছে, সেজন্য আমাদের মাঝে শূন্যতা বিরাজ করছে। সন্তানরা কোথাও হারিয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে। এটা কতটা কষ্টের ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। কথাগুলো বলছেন বান্দরবান জেলা গণগ্রন্থাগারের কয়েকজন পাঠক।
গতকাল শনিবার সকালে বান্দরবানের নয়াপাড়া এলাকায় বান্দরবান জেলা গণগ্রন্থাগারে গিয়ে দেখা গেছে, জ্ঞানের সম্ভার জেলা গণগ্রন্থাগার বন্যায় তছনছ হয়ে গেছে। জিনিসপত্র ভেঙে পড়ে সংরক্ষণশালা গ্রন্থাগারের সব বই বন্যার ময়লা পানি আর কাদামাটিতে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। এ যেন কোনো ধ্বংসস্তূপ। পুরো গ্রন্থাগারে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের মূল্যবান বই।

গ্রন্থাগার সংশ্লিষ্টরা জানায়, বান্দরবান জেলা গণগ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮২ সালে। ২০১০ সালে শহরের নয়াপাড়াস্থ নিজস্ব নতুন ভবনে গণগ্রন্থাগারটি স্থানান্তরিত হয়। এখানে দ্বিতীয় বারের মতো বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হলো জেলা গ্রন্থাগার। ২০১৯ সালে প্রথমবার বন্যায় তিন হাজারের মতো বই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এবারের বন্যায় গ্রন্থাগারের ২৮ হাজারের বেশি বই নষ্ট হলো। তার মধ্যে ব্রিটেনিকা, পিডিয়া, রবীন্দ্র রচনাবলি, নজরুল রচনাবলি ও অনুবাদের বইও রয়েছে। ছিল বিভিন্ন ধরনের অফিস নথি, মুক্তিযুদ্ধের দলিল দুটি সেট এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিল দুটি সেটও। এছাড়া কম্পিউটার দুটি, প্রজেক্টর একটি, স্ক্যানার একটি, চারটি সিসি ক্যামেরা এবং বই রাখার আসবাবপত্র। অপরদিকে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের গণগ্রন্থাগারের অধীনে পরিচালিত আব্দুলাহ আবু সাঈদের বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির প্রায় দেড় হাজার বইও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যায় ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির গাড়িটিও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় পাঠকসেবা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।
জেলা গণগ্রন্থাগারের নিয়মিত পাঠক রিশু চৌধুরী ও সাইফুল ইসলাম বলেন, পাহাড়ে জ্ঞানের আলো ছড়ায় জেলা গণগ্রন্থাগারটি। কিন্তু বন্যায় যেন সব শেষ করে দিল। জ্ঞান অর্জনে নিয়মিত সময় কাটানো গণগ্রন্থাগারের এমন দুর্দশা দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন তারা। অমূল্য সম্পদ যে বইগুলো নষ্ট হয়ে গেল, এগুলো কোথায় পাব? দ্রুত গণগ্রন্থাগারটি ঠিকঠাক করে পাঠকদের জন্য সমৃদ্ধ করে তোলার দাবি জানাচ্ছি।
জেলা গণগ্রন্থাগারের লাইব্রেরিয়ান পুনম চৌধুরী ও অফিস সহায়ক তুষার দেবনাথ বলেন, বৃষ্টিতে হঠাৎ করে বন্যার পানি দ্রুত গতিতে বেড়ে যায়। গণগ্রন্থাগারে আট-নয় ফুট পর্যন্ত পানি উঠেছে। শত চেষ্টা করেও কিছু রক্ষা করতে পারিনি। গণগ্রন্থাগার ভবনটি দু-তিনতলা হলে হয়তো সবকিছুই বাঁচানো যেত। খুবই কষ্ট লাগছে। প্রিয় গণগ্রন্থাগারের এমন দুর্দশা দেখে পাঠকরাও চিন্তিত।
ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরিয়ান প্রতিনিধি খুরশিদুল হাসান বলেন, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির প্রায় দেড় হাজারের মতো বইও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যার পানিতে ডুবে ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির গাড়িটিও নষ্ট হয়ে গেছে। তাই পাঠকসেবা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।
বান্দরবান জেলা গণগ্রন্থাগারের ইনচার্জ মাশৈ থুই চাক বলেন, গণগ্রন্থাগারে তালিকাভুক্ত ৩৪ হাজার বই রয়েছে। তার মধ্যে ২০১৯ সালের বন্যায় প্রথমবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তিন হাজারের মতো বই। এবার দ্বিতীয়বার বন্যায় নষ্ট হলো গণগ্রন্থাগারের ২৮ হাজারের বেশি বই। শুধু বই নয়, বিভিন্ন ধরনের অফিস নথি, মুক্তিযুদ্ধের দলিল এবং ৩৫ বছরের বাইন্ডিং করা বিভিন্ন পত্রিকার কপিও নষ্ট হয়ে গেছে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ শুরু করেছি। যতটুকু সম্ভব বইগুলো রক্ষার চেষ্টা করা হচ্ছে। গণগ্রন্থাগারের তালিকাভুক্ত পাঠক রয়েছেন সাড়ে তিন শতাধিক। নিয়মিত শতাধিকের বেশি পাঠক রয়েছেন গণগ্রন্থাগারের। বন্যার ক্ষতি থেকে গণগ্রন্থাগারটি রক্ষায় ভবনটি ওপরে দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলা সম্প্রসারণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে।