বন্যায় সিলেট-সুনামগঞ্জে সরবরাহ শৃঙ্খল বিপর্যস্ত

শেয়ার বিজ ডেস্ক: অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে সিলেট-সুনামগঞ্জের পর নেত্রকোনাও ডুবছে। ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে জেলার আরও তিনটি উপজেলা প্লাবিত হয়েছে। বন্যায় সিলেট ও সুনামগঞ্জ পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এ দুই জেলায় ব্যাংকিং সেবা বন্ধ হয়ে গেছে। সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। বিদ্যুৎ না থাকায় অনেকটা অন্ধকারে রয়েছে দুই জেলার বন্যার্ত মানুষ। ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসহ সার্বিক সরবরাহ শৃঙ্খল বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। নিরাপদ আশ্রয়, খাবার ও বিশুদ্ধ পানির জন্য মানুষ হাহাকার করছে। উভয় জেলাতেই উদ্ধারকাজে সেনা মোতায়েন করা হয়েছে।

তৃতীয় দফা বন্যার কারণে সুনামগঞ্জ-সিলেট এখন সারাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে। ভারতের মেঘালয় ও আসামে রেকর্ড বৃষ্টিপাতের কারণে এবার পরিস্থিতির আরও অবনতির শঙ্কা করা হচ্ছে। মেঘালয়ের পাদদেশেই রয়েছে নেত্রকোনার কলমাকান্দা ও দুর্গাপুর উপজেলা। এরই মধ্যে সিলেটের বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে সিলেট রেলস্টেশন। আগেই বন্ধ করা হয়েছিল বিমান চলাচল।

নেত্রকোনার পাশের সুনামগঞ্জ জেলা সদরের সঙ্গে দেশের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে শুক্রবার থেকেই। গতকাল ১১ উপজেলার অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থাও ভেঙে পড়েছে। বিদ্যুৎও নেই।

জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, সিলেট ও সুনামগঞ্জের ৩৫ লাখের মতো মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। নেত্রকোনা জেলার বন্যাকবলিত ছয় উপজেলার জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সেখানে প্রায় দুই লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ডুবছে নেত্রকোনাও: এদিকে বন্যায় সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় থাকা সুনামগঞ্জের পাশের নেত্রকোনায় শুক্রবার ভোর থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে থাকে। কলমাকান্দা, দুর্গাপুর ও বারহাট্টা উপজেলার বেশ কিছু জায়গা শুক্রবার ডুবে যায়। এতে কোথাও কোথাও সড়ক বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। শুক্রবার জেলায় সারাদিনই থেমে থেমে মুষলধারে বৃষ্টি হয়েছে। বিকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত টানা দুই থেকে তিন ঘণ্টার বৃষ্টিতে পানি বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। গতকাল শনিবার সকাল নাগাদ নতুন করে বানের পানি ঢুকে প্লাবিত হয়েছে জেলার সদর, মোহনগঞ্জ ও খালিয়াজুরী উপজেলা।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নেত্রকোনার নির্বাহী প্রকৌশলী এমএল সৈকত বলেন, ‘শনিবার সকাল ৯টায় সোমেশ্বরী নদীর পানি কলমাকান্দা পয়েন্টে ৪৪ সেন্টিমিটার বেড়েছে। এতে ওই নদীর পানি বিপদসীমার ১০০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। আর কংস নদের পানি জারিয়া-জাঞ্জাইল পয়েন্টে গত ২৪ ঘণ্টায় ১১০ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমার সাত সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।

এদিকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, জেলার মোট ছয়টি উপজেলার ৩৯টি ইউনিয়ন বন্যার কবলে পড়েছে। এতে অন্তত দুই লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।

জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ সাংবাদিকদের বলেন, স্থানীয় প্রশাসন এ নাগাদ বানভাসি মানুষদের জন্যে ১৮৮টি আশ্রয়কেন্দ্র খুলেছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে শুক্রবার রাত নাগাদ ১৬ হাজার ১৮০ মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। ৪৭৩ হেক্টর জমির আউশ ও সবজি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

বন্যাকবলিত এলাকায় ৬৮ মেট্রিক টন চাল, নগদ আড়াই লাখ টাকা এবং দুই হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার পাঠানো হয়েছে। আশ্রয় কেন্দ্রগুলোয় শুকনা খাবার ও বিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

সিলেট হয়ে লন্ডনগামী ফ্লাইট বাতিল: এদিকে সিলেট বিমানবন্দরের রানওয়েতে বন্যার পানি ঢুকে পড়ায় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস ঢাকা থেকে সিলেট হয়ে লন্ডনগামী সব ফ্লাইট বাতিল ঘোষণা করেছে। গতকাল এ খবর নিশ্চিত করেছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। বেবিচক জানিয়েছে, ফ্লাইট ২২ জুন পর্যন্ত বন্ধ থাকবে।

এরই মধ্যে সেখানে ফ্লাইট চলাচল বন্ধ রয়েছে। সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পরিচালক হাফিজ আহমদ সংবাদমাধ্যমকে জানান, একটি ফ্লাইট শনিবার সকাল ৮টায় ঢাকা থেকে সিলেট হয়ে লন্ডন যাওয়ার কথা ছিল। সেটি বাতিল করা হয়। এর মধ্যে আবার আগামীকাল রোববার এবং ২২ জুন বিমানের ঢাকা-সিলেট-লন্ডন ফ্লাইট রয়েছে। সেগুলোও বাতিল করা হয়েছে।

সূত্র জানায়, বাতিল করা ফ্লাইটের তারিখ পরে জানিয়ে দেয়া হবে। আর এর পরের ফ্লাইটের বিষয়ে ২১ তারিখে সিদ্ধান্ত হবে। শুক্রবার বিকালে সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ের কাছে বন্যার পানি প্রবেশ করায় বিমান চলাচল বন্ধ ঘোষণা করে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ।

সিলেট রেলওয়ে স্টেশনও বন্ধ: এদিকে বন্যার পানিতে রেললাইন তলিয়ে যাওয়ায় এবার সিলেট রেলওয়ে স্টেশন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সিলেট রেলওয়ে স্টেশনের স্টেশন ম্যানেজার নুরুল ইসলাম গতকাল শনিবার বলেন, পাহাড়ি ঢল ও অতিবৃষ্টির কারণে রেললাইন তলিয়ে যাওয়ায় সিলেট রেলওয়ে স্টেশন আপাতত বন্ধ থাকবে। ঢাকা বা চট্টগ্রাম থেকে এখন সরাসরি সিলেট স্টেশনে কোনো ট্রেন আসবে না। সকালে সিলেট স্টেশন থেকে ঢাকার উদ্দেশে ‘কালনী এক্সপ্রেস’ এবং ‘জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস’ ট্রেন ছেড়ে গেছে।

সিলেটের স্টেশন ম্যানেজার আরও বলেন, এখন ট্রেন সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জের মাইজগাঁও স্টেশন এবং মৌলভীবাজারের কুলাউড়া স্টেশন থেকে সম্ভবত চলাচল করবে। বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত এ অবস্থা চলবে বলে জানান নুরুল ইসলাম।

এর আগে সিলেটের কুমারগাঁও গ্রিড উপকেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ কক্ষে পানি ঢুকে পড়ায় সেটি বন্ধ করে দেয়া হয়। এতে সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলা বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

শনিবার দুপুর সোয়া ১২টার দিকে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয় বলে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সিলেট বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল কাদের বলেন, পানি উঠে যাওয়ায় আপাতত উপকেন্দ্রটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি, পানি সেচে দ্রুততম সময়ের মধ্যে এটি আবার চালু করতে।

সুনামগঞ্জে ব্যাংক লেনদেন বন্ধ, সিলেটেও বন্ধের পথে: বন্যায় সুনামগঞ্জ সড়কের পাশাপাশি মুঠোফোন যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন। ফলে সুনামগঞ্জে মানবিক বিপর্যয় নেমে এসেছে। বন্যার কারণে এটিএম বুথ তলিয়ে গেছে। অচল হয়ে পড়েছে এসব বুথ। ফলে আগামীকালের মতো আজও ব্যাংকিং সেবাও বন্ধ থাকবে। একই সঙ্গে সিলেটবাসীও পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ায় এ জেলার এটিএম বুথগুলোও একের পর এক অচল হয়ে পড়ছে। এ কারণে সুনামগঞ্জ ও সিলেটের ব্যাংকিং সেবা বন্ধের ঘোষণা দিতে শুরু করেছে ব্যাংকগুলো।

ব্র্যাক ব্যাংক এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, বন্যা পরিস্থিতির অবনতির কারণে সিলেট বিভাগের চারটি শাখার কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হচ্ছে। পরিস্থিতির উন্নতি হলে শাখাগুলো আবার চালু করা হবে। শাখাগুলো হলোÑসিলেট উপশহর, বিশ্বনাথ, দক্ষিণ সুরমা ও সুনামগঞ্জ শাখা।

এদিকে ডাচ্?-বাংলা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কাশেম মো. শিরিন ফেসবুকে ছবি শেয়ার করে এক পোস্টে লিখেছেন, প্রায় ৫০টি এটিএম বুথ বন্যার পানিতে ডুবে গেছে, যার বেশিরভাগই সুনামগঞ্জে, কিছু সিলেটের। তার শেয়ার করা ছবিতে দেখা যাচ্ছে, সুনামগঞ্জের ছাতকের ন্যাশনাল ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংকের শাখা ডুবে গেছে।

বন্যাদুর্গতদের উদ্ধারে নৌকা সংকট: প্রবল বৃষ্টিতে সিলেটে একের পর এক এলাকা তলিয়ে গিয়ে বানভাসি মানুষের সংখ্যা বাড়লেও তাদের উদ্ধারে হিমশিম খাচ্ছে প্রশাসন। সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মুজিবুর রহমান গতকাল বলেন, ‘অনেক মানুষ পানিবন্দি, কিন্তু নৌকার অভাবে আশ্রয় কেন্দ্রে আসতে পারছে না। বন্যায় অনাহারে থাকা লোকজন এখন কেবল প্রাণে বাঁচতে চান। কিন্তু একটি নৌকা মেলানো তাদের কাছে এখন সোনার হরিণ।’

চলতি মৌসুমে এটা সিলেটে তৃতীয় দফা বন্যা। ভারতের মেঘালয় ও আসামে রেকর্ড বৃষ্টিপাতের কারণে এবার পরিস্থিতির আরও অবনতির শঙ্কা করা হচ্ছে।

সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার মুহাম্মদ মোশাররফ হোসেন বলেন, সিলেট ও সুনামগঞ্জের ৩৫ লাখের মতো মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। আমরা চেষ্টা করছি তাদের উদ্ধার করে এনে আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে রাখতে। তবে উদ্ধারে নৌকা সংকট নিয়ে জেলা প্রশাসকের কথার প্রতিফলন পাওয়া যায় গোয়াইনঘাট উপজেলার আলিরগাঁও এলাকার আজিজ মিয়ার কথায়। তার ভাষ্যে, উপজেলার প্রায় শতভাগ মানুষ পানিবন্দি। কেউ ত্রাণ চায় না, প্রাণে বাঁচতে চায়। কিন্তু তাদের উদ্ধারের জন্য নৌকা পাওয়া যাচ্ছে না। আজিজ বলছেন, এমন ভয়ানক দুর্যোগ তিনি গত কয়েক দশকে দেখেননি।

পানিবন্দি মানুষদের উদ্ধারে সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনী মাঠে নেমেছে। বানভাসি মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে নেয়া হলেও সেখানে মুড়ি ছাড়া খাবার ও পানি জুটছে না বলেও অভিযোগ উঠেছে।

এদিকে আগামীকাল পর্যন্ত সিলেট ও সুনামগঞ্জে ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছেন সিলেট আবহাওয়া অফিসের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ সাঈদ আহমদ চৌধুরী।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০