বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ উপেক্ষা করে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়

জিয়া উদ্দিন মাহমুদ: বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাংলাদেশের জন্য নতুন কিছু নয়। ঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা ও ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা বিশ্বের অনেক দেশের চেয়েও বেশি। বাংলাদেশ নদীবিধৌত হওয়ায় এবং পদ্মা, মেঘনা, যমুনা ও তিস্তার মতো বৃহৎ নদীর অববাহিকায় অবস্থিত হওয়ায় প্রায় প্রতি বছর নদীর নিকটবর্তী বিশেষ করে ভাটি অঞ্চলগুলো গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালে কম-বেশি বন্যায় প্লাবিত হয়। বাংলাদেশের প্রধান প্রধান নদীর উৎপত্তিস্থল ভারত হওয়ায় প্রায়ই এসব অভিন্ন নদীর অববাহিকায় ভারতে বন্যা দেখা দিলে তার প্রভাব বাংলাদেশেও দেখা যায়। বাংলাদেশ ভারতের মধ্যে প্রায় ৫৪টি অভিন্ন নদী রয়েছে।

১৯৭২ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দুদেশের বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে অভিন্ন নদীর ব্যাপক জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা, বন্যা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, বন্যার পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণের বিস্তারিত প্রকল্প প্রণয়ন এবং প্রধান প্রধান নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও সেচ প্রকল্পের ওপর সমীক্ষা পরিচালন, উভয় দেশের জনগণের পারস্পরিক সুবিধার জন্য পানির ন্যায়সংগত ব্যবহার এবং বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতসংলগ্ন এলাকায় পাওয়ার গ্রিড সংযোজনের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য স্থায়ী ভিত্তিতে ভারত-বাংলাদেশের যৌথ নদী কমিশন গঠিত হয়।

নোয়াখালী, ফেনী ও কুমিল্লা বাংলাদেশের সমৃদ্ধ জেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম। উপকূলীয় এলাকায় অবস্থানের কারণে নোয়াখালী সাইক্লোন ও ঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হতে হয় প্রায়ই এবং এর মোকাবিলা ও ব্যবস্থাপনায় এই অঞ্চলে রয়েছে পর্যাপ্ত সাইক্লোন সেন্টার এবং নদী ও সমুদ্র উপকূলে রয়েছে বাঁধ, যা দুর্যোগ মোকাবিলায় কার্যকর। কিন্তু এইসব এলাকায় সাম্প্রতিক সময়ে সৃষ্ট বন্যা এই অঞ্চলের মানুষের জন্য একেবারেই নতুন এবং অনাকাক্সিক্ষত। কোনো ধরনের পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই এসব জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বিলীন হয়ে গেছে ঘরবাড়ি, দোকানপাট, গবাদি পশু ও ফসল। পানির পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষ আশ্রয় নিয়েছে ঘরের ছাদে ও চালে এমনকি গাছের মগডালে। প্রবল স্রোতের কারণে এবং বিদ্যুৎহীন হওয়ায় যোগাযোগবিছিন্ন হয়ে পড়েছে বিভিন্ন জনপদ। কোনো ধরনের বন্যার পূর্বাভাস না থাকায় মাত্র এক দিনের মাথায় তলিয়ে যায় এই বিস্তীর্ণ এলাকা। কিন্তু কী এমন প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হতে হলো যে, ফেনী, নোয়াখালী ও কুমিল্লার মতো সমৃদ্ধ এলাকাকে মুহূর্তেই করে দিল অসহায় জনপদ হিসেবে, যার মধ্যে সবচেয়ে দুর্যোগের শিকার ফেনী জেলা।

ফেনী জেলার কোলঘেঁষে প্রবাহিত হয় ফেনী নদী ও মুহুরী নদী, আর কুমিল্লা জেলায় রয়েছে গোমতি নদী, যার উৎপত্তিস্থল ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য। মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টির কারণে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে সৃষ্ট বন্যায় ত্রিপুরার খোয়াই, গোমতী, মুহুরী, হাওরা ও দালাই নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকে, যার ফলে বাংলাদেশের অববাহিকায় ফেনী, মুহুরী, গোমতী, খোয়াই ও মনু নদীর পানি হু-হু করে বৃদ্ধি পেতে থাকে। এর সঙ্গে এই অঞ্চলেও অতিবৃষ্টির পানি যুক্ত হয়, যার ফলে সৃষ্টি হয় বন্যার। এছাড়া অভিযোগ রয়েছে ভারত কোনো ধরনের পূর্বসতর্কতা না দিয়ে বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরে ত্রিপুরার গোমতী নদীতে অবস্থিত ডাম্বুর হাইড্রোপ্রজেক্ট ড্যাম খুলে দেয়ায় বাংলাদেশের ফেনী, কুমিল্লা আর নোয়াখালীর বিস্তীর্ণ এলাকার বন্যা পরিস্থিতির হঠাৎ করেই অবনতি ঘটে এবং এই অঞ্চলের প্রায় ৩০ লাখ মানুষ আজ পানিবন্দি। যদিও ভারত-বাংলাদেশের যৌথ নদী কমিশনের সংবিধি অনুযায়ী, ভারত বাংলাদেশকে বন্যার পূর্বাভাস দেয়ার কথা, তা সত্ত্বেও এমন কোনো পূর্বাভাস ভারত থেকে দেয়া হয়নি। যদিও ভারতের পক্ষ থেকে এ ধরনের তথ্য সত্য নয় বলে জানানো হয়েছে। তারা ব্যাখ্যা দিয়েছে, ভারতের ত্রিপুরায় অবস্থিত ডাম্বুর প্রজেক্টের গেট তারা ইচ্ছাকৃত খোলেনি। বরং পানি বেড়ে যাওয়ায় তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুলে গিয়ে বাংলাদেশের ভাটি অঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। তবে পরিস্থিতি যা-ই হোক, উজান এলাকার অবস্থিত হওয়ায় ভারত এ বিষয়ে পূর্বসতর্কতা জারি করলে বন্যা ঠেকানো না গেলেও বন্যাদুর্গত এলাকার মানুষ পূর্বপ্রস্তুতি নিতে পারত, যা হয়তো তাদের দুর্ভোগ লাঘবে সহায়ক হতো। এমনিতেই বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের নদীর পানির ন্যায্য প্রাপ্তি নিয়ে দীর্ঘদিনের সমস্যা রয়েই গেছে। এছাড়া ভারত প্রধান প্রধান নদীতে বাঁধ তৈরি করে পানি নিয়ন্ত্রণ করে আসছে, যার ফলে শুষ্ক মৌসুমে ও ভরা মৌসুমে পানির ন্যায্য অধিকার থেকে বাংলাদেশ প্রায়ই বঞ্চিত হচ্ছে এবং এর প্রভাব পড়ছে ভাটি অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকায়। তবে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যকার এই সমস্যাগুলো আতিগুরুত্ব দিয়ে কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের জন্য বাংলাদেশকেই সক্রিয় ভূমিকা পালনে আরও সচেষ্ট হতে হবে।

বন্যার জন্য ভারতকে একচেটিয়া দোষ দিয়ে আমরা আমাদের বিদ্যমান ব্যর্থতা, অবহেলা আর সীমাবদ্ধতাকে প্রশ্রয় দিয়ে সমস্যাকে ভবিষ্যতে যাতে আরও অতিরঞ্জিত করে না ফেলি, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। ফেনী, কুমিল্লা কিংবা নোয়াখালীর মতো নতুন নতুন এলাকায় বন্যায় প্লাবিত হওয়াটা কোনো বিছিন্ন ঘটনা নয়, বরং বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের একটা নতুন ধাপ। আবহাওয়ার চরমভাবাপন্নতার কারণে অতিবৃষ্টির কারণে পানির চাপ যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমনি বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে সমুদ্রের পানি বেড়ে যাওয়ায় নদীগুলো থেকে সমুদ্রে পানিপ্রবাহের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে দখলদারিত্বের কারণে নদীর নাব্য দিন দিন কমে যাচ্ছে, আর বিভিন্ন শাখা নদী ও খালগুলো ভরাট হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে, যা বন্যা সৃষ্টির জন্য একটা বড় কারণ। এছাড়া অপরিকল্পিত ও অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের কারণে নদীর নাব্যের পাশাপাশি নদীর পাড় ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যে বিষয়ে ফেনী বা এর আশেপাশের এলাকার নদীগুলোর বিষয়ে দীর্ঘদিন থেকে অভিযোগ ছিল। এছাড়া নদীর ওপর যত্রতত্র সেতু ও কালভার্ট তৈরির ফলে নদীতে প্রচুর পরিমাণ পলি জমে, যা নদীর নাব্য হ্রাস করে। এসব কারণে নদীর নাব্য যেমন হ্রাস পেয়েছে, তেমনি কমেছে প্রবহমান নদীর সংখ্যাও। সাম্প্রতিক নদী রক্ষা কমিশনের একটি প্রতিবেদনমতে, বাংলাদেশে প্রায় ৭৭০টি নদীর অস্তিত্ব ছিল, যার সংখ্যা বর্তমানে ৪০৫টি। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়েই প্রায় ১০০ নদী বিলুপ্ত হয়েছে।

তাই বন্যার কারণ হিসেবে এগুলোকে উপেক্ষা করে সঠিক সমাধান পাওয়া সম্ভব নয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, প্রকৃতিগতভাবেই ভাটি অঞ্চলের দেশ বাংলাদেশ। তাই বন্যার মতো প্রাকৃতিক সমস্যাকে কখনোই উপেক্ষা করে উন্নয়ন করা সম্ভব নয়। বন্যার্ত মানুষের যথাযথ ত্রাণ সহায়তা প্রদান হয়তো উদ্ভূত সমস্যার সাময়িক সমাধান মাত্র। কিন্তু দখলদারিত্ব থেকে নদীকে উদ্ধার, মৃতপ্রায় নদীর পুনর্জš§, নদীর নাব্য বৃদ্ধিতে যথাযথ ড্রেজিংয়ের ব্যবস্থা, নদীশাসন, নদীদূষণ রোধ করাসহ, কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করে নদীর পানির ন্যয়সংগত ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া আন্তর্জাতিক আদালতে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিপূরণ আদায় করে প্রকৃতির পুনর্গঠনে তার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এই সমস্যাগুলোর ফলপ্রসূ সমাধানের উদ্যোগ না নিলে ভবিষ্যতে নতুন নতুন এলাকায় প্লাবনের আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যাবে না এবং দেশের মানুষকে অনাকাক্সিক্ষত ক্ষতি থেকে রক্ষা করা অনিশ্চিতই থেকে যাবে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০