Print Date & Time : 22 June 2025 Sunday 1:58 am

বন্যায় আমনে ব্যাপক ক্ষতির শঙ্কা

নাজমুল হুসাইন: চলতি আমন মৌসুমের শুরুতে অতিবৃষ্টি ও উজানের পানিতে এক হাজার ১১৮ হেক্টর বীজতলাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। যা আবার পানি নেমে যাওয়ার পরে রোপণ করেছেন কৃষক। এমতাবস্থায় দেশে শুরু হয়েছে আবারও বন্যা, যা ক্রমেই ব্যাপক আকার ধারণ করছে। ইতোমধ্যে (১৪ আগস্ট পর্যন্ত) সারা দেশে প্রায় এক লাখ ১০ হাজার ৪১৫ হেক্টর আবাদি জমি প্লাবিত হয়েছে বলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যে জানানো হয়েছে। এতে চলতি আমনের বড় ক্ষতির শঙ্কা দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে সামগ্রিক খাদ্য নিরাপত্তায়।

দেশে প্রতিবছর প্রায় সাড়ে তিন কোটি টন চাল উৎপাদিত হয়। যার মধ্যে সিংহভাগ এক কোটি ৯০ লাখ টন আসে বোরো থেকে। তবে গত এপ্রিলে বোরো মৌসুমে হাওরের বন্যায় দুই লাখ ৫০ হাজার হেক্টর বোরো ফসলের ক্ষতি হয়। এতে প্রায় সাড়ে সাত লাখ টন ফসল নষ্ট হয়ে যায়। সেই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে আউশ আবাদের বাড়ানোর চিন্তা করে সরকার। আবাদ করা হয় ১০ লাখ ৯২ হাজার হেক্টর জমিতে। তবে গত জুলাইয়ে অতিবৃষ্টি ও উজানের পানিতে সাত জেলায় ১০ হাজার ৬৪১ হেক্টর আউশ ধানের জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপর আবার চলমান বন্যা আঘাত হেনেছে মাঠে থাকা আমনের ধানে।

কৃষিসংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমন সাধারণত নিচু জমিতে চাষ করা হয়। এতে বন্যা প্লাবিত এলাকায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতির শঙ্কা তৈরি হয়েছে। আর বন্যা দীর্ঘমেয়াদি হলে এসবের অধিকাংশই পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে না। পানি নেমে গেলে নতুন করে চারা রোপণ করা যাবে, তবে সময়ের ব্যবধানে উৎপাদশীলতা কমবে। এছাড়া চারা পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করারও ঝুঁকির মধ্যে।

বিআইডিএস’র ইমেরিটাস ফেলো এম আসাদুজ্জামান বলেন, ‘সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি প্রতিনিয়ত অবনতি হচ্ছে। পদ্মার পানি বেড়ে গেলে অর্ধেক দেশ প্লাবিত হওয়ার অবস্থা দাঁড়িয়েছে। এতে যে আমন নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বোরো ও আউশের পর এ পরিস্থিতি সার্বিক খাদ্য নিরাপত্তাকে আরও ঝুঁকিতে ফেলবে।’

তিনি বলেন, ‘যদি বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পরে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় কিছু আমন আবার রোপণের সুযোগ হয়, তবে সেই ফসলের উৎপাদনশীলতা অনেক কম হবে। অর্থাৎ আমনের ক্ষতি নিশ্চিত।’

এ বছর এপ্রিলে হাওরে বন্যা ও অতিবৃষ্টিতে ফসল নষ্ট হওয়ার পর চালের সংকট দেখা দেয়। অন্যদিকে সরকারের চালের মজুত স্বল্পতায় বিশ্বের চতুর্থ চাল উৎপাদনকারী দেশ বাংলাদেশ এখন বিশ্বের অন্যতম প্রধান আমদানিকারকে পরিণত হয়েছে। চালের সংকটে পড়ে চাল রফতানিকারক দেশগুলো থেকে আমদানির চেষ্টা করছে সরকার। গত দুই মাসে নানা উদ্যোগের পরেও এখনও চালের সংকট থেকে বেরোতে পারেনি বাংলাদেশ। দেশবাসীকে এখনও চালের জন্য গুনতে হচ্ছে ইতিহাসের সর্বোচ্চ দর।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের তিন প্রধান নদ-নদী ব্রহ্মপুত্র, যমুনা ও মেঘনার পানি বইছে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে। উজানের দেশ চীন, ভারত, নেপাল ও ভুটানে এ বছর স্মরণকালের মারাত্মক বন্যা হয়েছে। এ সময় বাংলাদেশের পাশাপাশি আসাম, অরুণাচল, তিব্বত, সিকিম, নেপাল ও ভুটানেও প্রবল বৃষ্টি হচ্ছে। ওই পানি বাংলাদেশের দিকে আসছে। যাতে দেশে বন্যা পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আগামী তিন দিন দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। আর পাঁচ থেকে সাত দিনের মাথায় বন্যার পানিতে ডুবতে পারে রাজধানীর নিম্নাঞ্চল।

বন্যায় দেশের অভ্যন্তরে এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দিনাজপুর, রংপুর, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, জয়পুরহাট, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, বগুড়া, সিরাজগঞ্জসহ ২০ জেলার ৫৬ উপজেলা। এসব এলাকায় রোপা আমন জমি ও আমন বীজতলা তলিয়ে গেছে বলে কৃষি বিভাগ জানিয়েছে।

জয়পুরহাট কৃষি বিভাগ বলছে, জেলার প্রায় দুই হাজার ২২৫ হেক্টর জমির ধান ও ফসল ডুবে গেছে। তবে জেলার কৃষকদের দাবি, কেবল বিল হাওয়াই মাঠেই প্রায় চার-পঁাঁচ হাজার হেক্টর জমির ধান এখন পানির নিচে।

জেলা কৃষি বিভাগের উপপরিচালক সুধেন্দ্রনাথ রায় জানিয়েছেন, জেলার নি¤œাঞ্চলের প্রায় দুই হাজার ২০০ হেক্টর জমির রোপা আমন ধানক্ষেত পানিতে তলিয়ে গেছে। নতুন করে আরও অনেক এলাকা প্লাবিত হচ্ছে।

শুধু জয়পুরহাট নয়, বন্যাপ্লাবিত প্রতিটি জেলার বন্যায় আমনের এমন পরিস্থিতি। রংপুরে পানিতে ডুবে গেছে রোপণকৃত আমন খেতসহ বিভিন্ন রবি ফসলও। পঞ্চগড়ে তিন হাজার ৩৭৫ হেক্টর আবাদি জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। নওগাঁয় তলিয়ে গেছে কয়েক হাজার একর জমির ধান। দিনাজপুরের পার্বতীপুরে ১৫ হাজার হেক্টর জমির সদ্য রোপা আমন খেত ডুবে গেছে। শেরপুরে পাঁচ শতাধিক হেক্টর জমির রোপা আমন ধান, আমন বীজতলা নিমজ্জিত হয়েছে বলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে।

উত্তরবঙ্গের পাশাপাশি সুনামগঞ্জেও প্রায় পাঁচ হাজার হেক্টর জমির রোপা আমন ও ৭৯৫ হেক্টর জমির বীজতলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বন্যা ও ঢলের পানিতে। গতকাল সেখানে কংস নদের পানি ১৬০ সেন্টিমিটার, উব্দাখালী ৯৪ সেন্টিমিটার ও ধনু নদীর পানি ৩৬ সেন্টিমিটার বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।