বন্যা ও পাহাড়ি ঢলে দিশাহারা কৃষক

মাসুদ রানা: বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি, চিরসবুজ এ দেশটির অর্থনীতি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। কৃষিতে বাংলাদেশের সাফল্য ঈর্ষণীয়। ক্রমাগত কৃষিজমি কমতে থাকা, জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও বৈরী প্রকৃতিতেও খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উদাহরণ। বাংলাদেশে উৎপাদিত প্রধান শস্যগুলোর মধ্যে রয়েছে ধান, গম, আলু, পাট, সরষে, মরিচ, মসুর, খেসারি, আখ প্রভৃতি। প্রধান ফসল বলতে আমরা সেই ফসলগুলোকে বুঝি যেগুলো একটি দেশের মোট শস্য চাষ এলাকার শতকরা এক ভাগ বা ততধিক এলাকায় উৎপাদিত হয়। বাংলাদেশে উৎপাদিত ফসলগুলোর মধ্যে ধান প্রধান খাদ্যশস্য হিসেবে চাষাবাদ হয়ে থাকে। বাংলাদেশে আউশ, আমন ও বোরো মৌসুমে ধান উৎপাদিত হয় এবং হেক্টরপ্রতি গড় উৎপাদন দুই দশমিক ৪৩ টন। উৎপাদনের বিচারে বোরো শীর্ষে এবং তারপরেই রয়েছে আমন ও আউশ। উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান মোট জমির প্রায় ৭০ শতাংশ দখল করলেও ফলন মোট উৎপাদনের প্রায় ৮৩ শতাংশ। বাংলাদেশে ধান চাষের আওতায় রয়েছে মোট শস্যক্ষেত এলাকার ৭২ শতাংশ জমি। বছরজুড়ে এখানে ধান চাষ হয়ে থাকে ফলে গ্রামাঞ্চলের কর্মসংস্থানের প্রায় ৭৫ শতাংশ ধান চাষনির্ভর। বাংলাদেশে মোট কৃষিজমির ৪৬ শতাংশজুড়ে রোপা আমন চাষাবাদ হয়, বোরো, আউশ ও বোনা আমন চাষাবাদ হয় যথাক্রমে ৩৯ শতাংশ, ১০ শতাংশ ও পাঁচ শতাংশজুড়ে। 

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এ বছর সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে আমন ও আউশ ধানের। মার্চ-এপ্রিলে অতিবৃষ্টির পর মে মাসে ঘূর্ণিঝড় আম্পান আর জুনের শেষে শুরু হওয়া বন্যায় মোট তিন দফায় ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যার পানিতে ডুবে গেছে প্রায় এক লাখ ৮৬ হাজার হেক্টর জমির ফসল যার ৭০ শতাংশই ধান। কৃষি খাতে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। এবারের বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার জেলা কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, রংপুর ও জামালপুর। গত জুনে যখন বন্যা শুরু হয় তখন উত্তরাঞ্চলের মাঠজুড়ে ছিল আমন ধানের বীজতলা, আউশ ধান, গ্রীষ্মকালীন সবজি ও পাট। বন্যার পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বেশিরভাগ জমির ফসল ও বীজতলা। আগাম বন্যা ও পাহাড়ি ঢলে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ায় কৃষকরা দিশাহারা হয়ে পড়েছেন। যার প্রভাব পড়তে পারে এ বছর আমন ধান উৎপাদনে। কৃষি অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, আমন ধানের উৎপাদন কম হলে দেশে চালের দাম বেড়ে যেতে পারে। ফলে দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর খাদ্য ঘাটতি পূরণে বিদেশ থেকে চাল আমদানি করতে হতে পারে ঠিক যেমনটি হয়েছিল ২০১৭ সালে হাওরে ফসল বিপর্যয়ের পরে। যেহেতু বাংলাদেশ একটি দুর্যোগপ্রবণ দেশ। তাই যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য প্রয়োজন আগাম দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তার যথাযথ বাস্তবায়ন। পদক্ষেপগুলোর মধ্যে রয়েছেÑএক. বন্যা সহনশীল ও আগাম (ধান ও অন্যান্য ফসলের) জাত উদ্ভাবন ও কৃষকদের মাঝে প্রসার ঘটানো; দুই. পরিকল্পিত ও টেকসই বন্যা প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণ ও যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ: তিন. সঠিক সময়ে আবহাওয়ার পূর্বাভাসের মাধ্যমে আসন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ সম্পর্কে কৃষকদের সতর্কীকরণ ও ক্ষয়ক্ষতি হ্রাস করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ: চার. নিয়মিতভাবে ড্রেজিং বা নদী শাসন ও খাল খনন এবং পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে নদ-নদীর পানি ধারণক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ এবং পাঁচ. দুর্যোগ-পরবর্তী সময়ে ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে কৃষকদের আর্থিক প্রণোদনা প্রদান ও প্রয়োজনীয় কৃষি উপকরণের সহজলভ্যতা নিশ্চিতকরণ।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৮-এর তথ্যমতে, দেশের মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৪০ শতাংশ জোগান দেয় কৃষি খাত এবং দেশের জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ। দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্য দূরীকরণ, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও খাদ্য নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা কৃষি খাতের অভাবনীয় ধারাবাহিক সফলতা আগামী দিনগুলোতে আরও বেগবান হবে এবং বাংলাদেশ হয়ে উঠবে ক্ষুধা, দারিদ্র যমুক্ত সুখী ও সমৃদ্ধিশালী স্বপ্নের সোনার বাংলা।

প্রভাষক

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০