বন্যা-পরবর্তী লালমনিরহাট সংকটে নারী-শিশু ও পশুপাখি

ফারুক আলম, লালমনিরহাট: উত্তরের জেলা লালমনিরহাটে দুই দফায় বন্যায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ভিটেমাটিহারা হয়েছেন অনেকেই। দ্বিতীয় দফার বন্যার পানি কমলেও জেলার নিন্মাঞ্চলে এখনও পানির নিচে রয়েছে। বন্যায় বিপন্ন হয়েছে অনেক প্রাণ। সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়েছে নারী-শিশু ও গবাদিপশু। জেলায় ছোট বড় নদীর সংখ্যা ১৭টি। বন্যার ফলে সব নদীতেই বেড়ে পানি। দ্বিতীয় দফার বন্যায় ভেঙে গেছে জনজীবনের সব কিছু। ন্যূনতম জীবনমানের প্রতিষ্ঠা পায়নি, টিকিয়েও রাখা যায়নি। পৌঁছায়নি পর্যাপ্ত ত্রাণ, চিকিৎসা সেবা, পশু চিকিৎসা, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলের কোনো সেবাও।

জেলার নি¤œাঞ্চলের চর ফলিমারি, বোয়ালমারি, গোবর্ধন, চর খুটামানা, খাটটামারি, চর ওসমানীনগর, চর খুনিয়াগাছ, শৌলমারী, চরইচলিসহ বেশ কিছু চরের সরেজমিন চিত্র ছিল ভয়ানক। এসব চরের ঘরবাড়ির ভেতর দিয়ে স্রোত বয়ে গেছে। কোনো কোনো বাড়ির চতুর্দিকে পানি। গৃহবন্দি মানুষ। খাবার নেই ঘরে। সারা দিনে একবার খাবার রান্না করছেন কেউ চৌকির ওপর বসানো অস্থায়ী চুলায়। অধিকাংশ বাড়িতে পুরুষ মানুষ নেই। সকালে বেরিয়ে গেছেন হাটে বাজারে। ফিরবেন একবারই রাতের বেলা। সারাদিনে একবারই ফিরেন তারা। পানিবন্দি আর অর্ধাহারে থাকেন নারী ও শিশুরা। তাদের যাওয়ার জায়গা নেই। তিন-চারবার পরনের কাপড় বদলাতে হয়। বারবার ভেজা কাপড় পরিধান করে শরীরে হয়েছে চুলাকানি (স্কাবিকস), ফাঙাসসহ পানিবাহিত রোগ।

মাঝিরা শ্যালোচালিত নৌকা নিয়ে মাঝ নদীতে বারবার যাচ্ছেন, বানে ভেসে আসা ছোট কাঠ, আধাপাকা ফসল, কলার ঝুকি উদ্ধারে। কোনোটা নেয়ার মতো, কোনোটা পশু খাদ্যও নয়। সামান্য উঁচু জায়গায় সমন্নিতভাবে রাখা হয়েছে গরু, ছাগল, হাঁসমুরগি। এসব প্রাণীরও খাবার নেই।

ইউনিয়ন পরিষদ ও সরেজমিন তথ্যমতে, লালমনিরহাট সদরের ৬ ইউনিয়ন, খুনিয়াগাছ, রাজপুর, গোকুন্ডা, কুলাঘাট, বড়বাড়ী, মোগলহাট। আদিতমারীর উপজেলায় দুর্গাপুর, পলাশীর কিছু অংশ, মহিষখোচা। কালিগঞ্জ উপজেলার তুসভাণ্ডার, কাকিনা, ভোটমারি। পাটগ্রামে উপজেলার শ্রীরামপুর, পাটগ্রাম, বুড়িমারী, কুচলিবাড়ী, জগৎবেড়, জোংড়া, বাউরা। হাতিবান্ধা উপজেলার ডাউয়াবাড়ি সিন্দুর্না, গড্ডিমারি, বড়খাতা, সানিয়াজান ইনিয়নের লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়।

কিছুদিন আগে একটা বন্যা হয়ে গেছে। অনেক মানুষ না খেয়ে আছে। এখন পানি অনেকের বাড়িতে। চলাচল করা খুব কঠিন।

পেনসিল বেগম (৭৫) জানান, বন্যার কারণে রান্নাবান্না করা খুব কষ্ট। কোনো ডাক্তার কবিরাজ নেই। সরকারি কোনো ডাক্তার নেই। পশুপাখির কোনো ডাক্তার নেই। ল্যাট্রিন নেই। মেয়ে মানুষের খুব কষ্ট।

ঈমান আলী (৯০) বলেন, স্যালাইনের কোনো খবর নেই। গরুছাগলের কোনো ডাক্তার নেই। কীভাবে মানুষের জীবন কাটবে। গদির ওপর বসি থাকলে হবে না। মানুষ ঘরবন্দি। তিন দিন থেকে মানুষগুলা না খেয়ে।

মোগলহাট ইউপি চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান বলেন, মোগলহাটের ধরলা অববাহিকা এবং মেইনল্যান্ডে ২০০০ পরিবার পানিবন্দি রয়েছে। ইউনিয়নের ছোট ছোট কালভার্টের মুখ বন্ধ করা, পানিবন্দির একটি কারণ। ওসমানগণীর চর, খাটামারি চর, চর ফলিমাড়ীর চরসহ অনেকে চরে পানিবন্দি রয়েছে। এ যাবৎ ১০ টন চাল বিতরণ করা হয়েছে। এ দফার বন্যার কারণে আবার বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে।

মহিষখোচা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোসাদ্দেক হোসেন চৌধুরী তার নিজ ইউনিয়নে ৫ হাজার পরিবার পানিবন্দি আছেন বলে জানান।

জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার (ত্রাণ ও দুর্যোগ) নাজিয়া নওরীন বলেন, আমরা প্রতিনিয়ত ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করছি। এ পর্যন্ত ৪২৩.৬ মেট্রিক টন চাল বিতরণ করা হয়েছে। ৩৫০ মেট্রিক টন চালের বরাদ্দ এখনও পৌঁছায়নি।

সিভিল সার্জন ডা. নির্মলেন্দু রায়, স্বাস্থ্য বিষয়ে গণমাধ্যম সঙ্গে কথা বলতে চাননি।

এদিকে জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, লালমনিরহাটে বন্যা পরিস্থিতির উন্নত হলেও গতকাল রোববার তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে ৩০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছে। আর ধরলা নদীর শিমুলবাড়ি পয়েন্টে ৬১ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০