‘বয়কট’ কি সব সমস্যার সমাধান?

মো. মিজানুর রহমান:সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে চায়ের দোকান পর্যন্ত প্রায় সবখানে বর্তমানে একটি বহুল ব্যবহƒত শব্দ হচ্ছে ‘বয়কট’। খুব সাধারণভাবে বয়কট বলতে আমরা বুঝি সামাজিকভাবে কারও সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছেদ করা বা কাউকে একঘরে করে রাখা। অন্যভাবে  বলতে গেলে কোনোকিছুর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের অংশ হিসেবে সেই বস্তুর ব্যবহার থেকে ব্যক্তিগত বা সামাজিকভাবে বিরত রাখা, কিংবা ঘৃণা প্রকাশের অংশ হিসেবে সংশ্লিষ্ট বিষয়কে বর্জন করাকে বয়কট বলে। ইন্টারনেট থেকে ঘাঁটাঘাঁটি করে যতটুকু জানতে পেরেছি, চার্লস কানিংহাম বয়কট নামক এক ইংরেজ ভদ্রলোককে যখন তার কার্যকলাপের জন্য আয়ারল্যান্ডের মায়ো কাউন্টির বর্গাচাষিরা সামাজিকভাবে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে, ঠিক তখন থেকে ‘বয়কট’ শব্দটি ইংরেজি অভিধানে অভিধানভুক্ত হয়।

প্রথম দিকে বয়কট শব্দটির ব্যবহার খুব বেশি না থাকলেও বর্তমানে এর ব্যবহার বা প্রয়োগ অত্যধিক। বিশেষ করে সামাজিক কিংবা অথনৈতিক উদ্দেশ্যের চেয়েও বয়কট শব্দটি বর্তমানে নোংরা রাজনীতির রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহƒত হচ্ছে। আগে না শোনা গেলেও বেশ কয়েক বছর ধরে আমাদের বাংলাদেশেও নানাবিধ কারণে এই বয়কট শব্দটি নানাজনের মুখেমুখে শোনা যাচ্ছে। কিছুদিন পরপর ফ্রান্স বয়কট, ইতালি বয়কট, ভারত বয়কট, পাকিস্তান বয়কট, আড়ং বয়কট, চীনা পণ্য বয়কট প্রভৃতি যেন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বস্তুতপক্ষে খুব কম মানুষই পাওয়া যাবে যারা বয়কট বা বর্জন সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান রাখে, কিংবা এই বয়কটের পজিটিভ বা নেগেটিভ প্রভাব সম্পর্কে অবগত আছে।

যেহেতু আমরা এখন বিশ্বায়নের যুগে বাস করছি, ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই আমাদের অন্য দেশের ওপর নানাবিধ কারণে নির্ভর করতে হয়। শুধু আমরাই নই, বরং বিশ্বে খুব কম দেশই পাওয়া যাবে যারা স্বয়ংসম্পূর্ণ বা অন্য দেশের উপর নির্ভরশীল নয়। এমনকি উন্নত দেশ বলতে আমরা যাদের বুঝি, তারাও নানাবিধ কারণে অন্য দেশের ওপর নির্ভরশীল। আসলে এটাই হলো বিশ্বায়নের সৌন্দর্য। কিন্তু আমাদের দেশ, যেটি স্বাধীনতার এত বছর পরও এখনও নিজের পায়ে দাঁড়াতেই হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে কথায় কথায় বিশেষ কোনো দেশ বা কোম্পানি বা পণ্যকে বয়কট করা এককথায় বিলাসিতা ছাড়া কিছুই নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারত থেকে প্রতি বছর প্রায় ১৪ মিলিয়ন বা এক কোটি ৪০ লাখ ডলারের পণ্য আমদানি করা হয়। চিকিৎসার জন্য প্রতি বছর প্রায় ২৫ লাখ বাংলাদেশি ভারত গমন করে। ইউরোপের দেশ ফ্রান্স গার্মেন্টসহ হিমায়িত খাদ্য, মসলা, হস্তশিল্প, পাট ও পাটজাত দ্রব্যসহ নানাবিধ পণ্যের অন্যতম বৃহৎ আমদানিকারক। ইউরোপের আরেক দেশ ইতালিও আমাদের পোশাকশিল্পের অন্যতম বৃহৎ বাজার। ফলে খুব স্বাভাবিকভাবে এটা মানতেই হবে যেহেতু আমাদের রপ্তানিযোগ্য পণ্যের পরিমাণ খুবই কম এবং বেশ কিছু বৃহৎ উন্নয়ন প্রকল্প এখনও চলমান, সেহেতু আমাদের উচিত সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা। আর আমাদের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম মূল নীতি হলো সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা, কারও সঙ্গে বৈরিতা করা নয়। দেখা যাবে, যে বা যারা এই বয়কট বিষয়টিকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশি তৎপর, তাদের কাছে ধর্ম কিংবা সামাজিক উদ্দেশ্যের চেয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলই মুখ্য।

বেশ কিছুদিন ধরে বহুজাতিক কোম্পানি কোকাকোলাকে বয়কট করার ডাক দিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পক্ষে-বিপক্ষে নানাবিধ আলোচনা করা হচ্ছে। আমি কোকাকোলার পক্ষ কিংবা বিপক্ষ কোনোদিকেই নই, তবুও একটা বিষয় আমার কাছে খুবই অবাক হওয়ার মতো যে কোকাকোলা বাংলাদেশসহ এই উপমহাদেশে প্রায় ৪০ বছরের চেয়েও বেশি সময় ধরে ব্যবসা করছে। সারা পৃথিবীতেই তাদের কারখানা রয়েছে। বিশ্বের কোনো দেশ, এমনকি কোনো মুসলিম রাষ্ট্রও তাদের বিরুদ্ধে আজ পর্যন্ত কোনো কটু মন্তব্য করেনি, তাহলে শুধু আমাদের দেশ থেকে কেন কোকাকোলা বয়কটের ডাক এলো?

বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর হিসাবমতে, শুধু গত পাঁচ বছরেই বাংলাদেশে প্রায় এক হাজার ৭০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে বহুজাতিক এই কোম্পানিটি। এই কোম্পানিতে প্রায় ৭৯ হাজার লোক কর্মরত আছে। কোকাকোলার মতো আরেক বৃহৎ কোম্পানি হলো প্রাণ-আরএফএল। আমাদের দেশের খুব কম মানুষই পাওয়া যাবে যারা তাদের জীবনে একটিবারও প্রাণের কোনো পণ্য ভোগ করেনি, কিংবা আরএফএলের কোনো প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার করেনি। সম্প্রতি কোকাকোলা বা প্রাণ-আফএফএল বয়কটের নামে যে প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হচ্ছে তার মেক্রোইকোনমিক প্রভাব কি কেউ ভেবে দেখেছে? ধরি, বয়কটের কারণে বাংলাদেশ থেকে কোকাকোলা তাদের উৎপাদন বন্ধ করে এদেশ ত্যাগ করল, তাহলে তাদের চলে যাওয়াতে কার লাভ হবে? বস্তুতপক্ষে কে লাভবান হবে, তা সুনির্দিষ্ট করে বলা না গেলেও আমাদের অর্থনীতি যে বিশাল ক্ষতির মুখে পড়বে, তা আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি। কোকাকোলা কোম্পানি থেকে সরকার প্রতি বছর যে বিপুল পরিমাণের রাজস্ব আদায় করে থাকে, তা নিশ্চিতভাবে বন্ধ হয়ে যাবে। ৭৯ হাজার লোক যারা এই কোম্পানিতে কাজ করছে, তারা বেকার হয়ে যাবে। সাধারণ মানুষ যারা না জেনে প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছে, তারা কি এ বিষয়ে ভেবে দেখেছে?

কয়েক বছর আগে কোকাকোলার মতো আরেক কোমল পানীয় পেপসি বর্জন করার মতো প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হয়েছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। বলা হচ্ছিল পেপসির পুরো নাম হচ্ছে ‘পে ইচ পেনি টু সেভ ইসরায়েল’, কিন্তু বাস্তবে এটি পেপসির আসলেই পুরো নাম কি না, তা আমার জানা নেই। ইন্টারনেটেও দেখলাম এরকম কোনো নামই পেপসির নেই। তার মানে এটাও নিছক মিথ্যা সমালোচনা ছাড়া কিছুই ছিল না।

একটা বিষয় খুব স্পষ্ট করে আমাদের সবার জানা উচিত, বহুজাতিক কোম্পানিগুলো দেশীয় কোনো কোম্পানির মতো নয়। এদের মার্কেট এক্সপোজার পৃথিবীজুড়েই বিস্তৃত। অযথা এসব কোম্পনির বিরুদ্ধে কিছু বলা মানে নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারার সমান। কোনো বহুজাতিক কোম্পানি যখন অন্য কোনো দেশে বিনিয়োগ করে, তা যেমন সেই দেশের সুনামের জন্য অত্যন্ত পজিটিভ বিষয়, ঠিক তেমনিভাবে অস্থিতিশীল কোনো পরিস্থিতির কারণে যখন কোনো বহুজাতিক কোম্পানি ব্যবসা বন্ধ করে সেই দেশ ত্যাগ করে, তাও সেদেশের সুনামের জন্য অত্যন্ত অসম্মানজনক বিষয়। আমাদের ইপিজেডগুলোয় বিদেশি কোম্পানির যে বিশাল অঙ্কের বৈদেশিক বিনিয়োগ আছে, অজ্ঞতাবশত কথায় কথায় বয়কট নিয়ে মিথ্যা প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হলে তার প্রভাব নিশ্চিতভাবেই পড়বে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর।

আমরা ২০১৭ সালে দেখেছিলাম, মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সমস্যা যখন প্রকট, ঠিক তখন আমাদের দেশেরই কিছুসংখ্যক লোক ধর্মের দোহাই দিয়ে রোহিঙ্গাদের আমাদের দেশে আশ্রয় দেয়ার জন্য নানাভাবে সরকারকে চাপ দিয়েছিল। কিন্তু এই রোহিঙ্গা সমস্যাটি যখন আমাদের দেশের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে, ঠিক এরাই আবার এখন সরকারকে নানাভাবে দোষারোপ করছে ‘রহিঙ্গাদের কেন এদেশে আশ্রয় দেয়া হয়েছিল’ তা নিয়ে।

মূলত যে বা যারা এরকম প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছে, তাদের উদ্দেশ্য মোটেও ভালো নয়। এ রকম মিথ্যা সংবাদ প্রচার কোনো নতুন বিষয় নয়। অতীতকালেও এরকম চর্চা করা হয়েছিল, বর্তমানেও করা হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হয়তো এটি অব্যবহƒত থাকবে। দেশ ও সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলাই কতিপর দুষ্ট শ্রেণির মূল উদ্দেশ্য। ২০২৬ সালে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা লাভ করবে, ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই আমাদের রপ্তানিযোগ্য অনেক পণ্য, যেগুলো এখন শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পাচ্ছে, তাদের অনেকেই তখন হুমকির মুখে পড়বে। আমরা এখন যাদের কথায় কথায় বয়কট করছি, ঠিক তারা যদি তখন আমাদের পণ্যের ওপর বিবিধ কারণে বয়কট কিংবা বর্জন করে, তখন দেশের অর্থনীতির কী অবস্থা হবে?

একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে দেখলাম কোকাকোলা বয়কটকে সমর্থন করা যায় কি যায় না, তা নিয়ে অনলাইন জরিপ চালানো হচ্ছে। এটাও কোনো সভ্য সমাজের জরিপ হতে পারে না। আসলে আমাদের উদ্দেশ্য যদি সৎ হতো, তাহলে দরকার ছিল এই বয়কটের প্র্যাকটিস নিজ দেশ থেকেই শুরু করা। দেশে যারা দুর্নীতিবাজ, কালোবাজারি, মজুতদার, মাদক ব্যবসায়ী আর যৌতুকলোভীÑসবার আগে সামাজিক কিংবা অথনৈতিক সব ক্ষেত্রেই তাদের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করা, তাদের সব ছোট-বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে বয়কট করা। সৎ সাহস নিয়ে এরকম প্রচারণা চালালে ধর্মীয় কিংবা সামাজিক সব ক্ষেত্রেই লাভবান হওয়া সম্ভব।

আমাদের সবারই মনে রাখা উচিত বিশ্বায়নের যুগে আবেগের কোনো স্থান নেই। আমাদের আরও বেশি প্র্যাকটিক্যাল হতে হবে। জ্ঞান-বিজ্ঞানে এতটাই উন্নত হতে হবে যেন আমাদের আর নতুন করে কোনো পণ্য আমদানি না করতে হয়, কিংবা বহুজাতিক কোম্পানির উৎপাদিত পণ্যের চেয়েও আমাদের নিজস্ব পণ্যের গুণগত মান অনেক বেশি ভালো হয়। যতদিন না পর্যন্ত আমরা নিজেদের মাঝে আমূল পরিবর্তন না আনতে পারব, সারা পৃথিবীতে নিজেদের একটা শক্ত অবস্থান তৈরি না করতে পারব, তত দিন এরকম বয়কট নামক প্রোপাগান্ডা কোনো কাজে আসবে না। বরং দিনকে দিন সারা পৃথিবী থেকে আমরা নিজেদের গুটিয়ে নেব। এর ফলে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি আমাদেরই হবে। শান্তিপূর্ণ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই সব সমস্যা ও মতানৈক্যের সমাধান করা সম্ভব। তাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কোনো দেশ, প্রতিষ্ঠান বা বিশেষ কোনো পণ্যকে নিয়ে কোনো কিছু লেখা বা শেয়ার করার আগে তা আমাদের জাতীয় স্বার্থে কতটুকু ভূমিকা রাখবে, তা কয়েকবার ভেবেচিন্তে মন্তব্য করা উচিত।

সহযোগী সদস্য

দি ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড সেক্রেটারিজ

অব বাংলাদেশ (আইসিএসবি)

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০