বরিশালে সোনালী ব্যাংকে কৃষিঋণের নামে হরিলুট

আরিফ হোসেন, বরিশাল: হঠাৎ কয়েকজন কৃষককে ব্যাংক থেকে ফোন দিয়ে কৃষিঋণের সব টাকা পরিশোধের জন্য চাপ দেয়া হয়েছে। নতুবা মামলা করা হবে বলে হুমকি দিয়েছেন ব্যাংক কর্মকর্তারা। এ ঘটনার পর থেকে ঋণ উত্তোলন না করেও এখন দেনাদার হওয়া কৃষকদের মাঝে হতাশা ও মামলার আতঙ্ক বিরাজ করছে। এ নিয়ে বিশেষ অনুসন্ধানে জানা গেছে, কৃষিঋণের নামে ব্যাপক হরিলুট হয়েছে বরিশালের সাহেবের হাটে সোনালী ব্যাংক শাখায়।

চিহ্নিত কয়েকজন দালালের মাধ্যমে ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তা জমির ভুয়া পর্চা, চেয়ারম্যানের সার্টিফিকেট, জামিনদার, এনআইডি কার্ডের ফটোকপি, ছবি, ভুয়া স্বাক্ষর ও টিপসই দিয়ে গ্রামের সহজ-সরল মানুষের নামে বছরের পর বছর ঋণ বিতরণ দেখিয়ে পুরো টাকা আত্মসাৎ করে নিয়েছেন। বেশিরভাগ গ্রাহক জানেন না ব্যাংকঋণের বিষয়ে। আবার কেউ কেউ দালালের খপ্পরে পরে ঋণের টাকার নামেমাত্র হাতে পেয়েছেন। যাচাই-বাছাই না করেই দালালের মাধ্যমে কতিপয় ব্যাংক কর্মকর্তার যোগসাজশে কীভাবে এমন ঘটনা ঘটেছে, তা নিয়ে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সচেতন নাগরিকরা।

বরিশাল সিটি করপোরেশনের ১০ নম্বর ওয়ার্ডের ভোটার মো. আল-আমিন গাজী জানান, তার নামে ব্যাংকঋণ হয়েছে, অথচ তিনি কখনও ব্যাংকের ধারেকাছেও যাননি। ২০১৭ সালের ১২ সেপ্টেম্বর তাকে চরকাউয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা দেখিয়ে ০৩৩১৯৬২০০০২৬৪ নম্বর ঋণ অ্যাকাউন্টে জমির ভুয়া পর্চা, জামিনদার আর স্বাক্ষর দিয়ে তার নামে ২০ হাজার টাকার ঋণ উত্তোলন করা হয়। অথচ ভূমিহীন হওয়ায় সরকারের পক্ষ থেকে তাকে ঘর দেয়া হয়েছে। তার নামে কোনো জমি নেই বলে দাবি করে আল-আমিন আরও জানান, কীভাবে তার নামে ঋণ উত্তোলন করা হয়েছে তা তিনি জানেন না।

তিনি বলেন, সম্প্রতি ব্যাংক ম্যানেজার নজরুল ইসলাম তাকে ফোন করে ঋণের সব টাকা পরিশোধের জন্য চাপ দেন। অন্যথায় তার বিরুদ্ধে মামলা দায়েরেরও হুমকি দেয়া হয়েছে। এরপর তিনি জানতে পারেন তার নামে ব্যাংক থেকে ঋণ উত্তোলন করা হয়েছে।

মো. সালাম গাজী নামের অপর এক গ্রাহক জানান, ২০১৬ সালে ঋণ হিসেব নম্বরে (০৩৩১৯৬২০০০১৭৪) তার নামে ২৪ হাজার টাকা উত্তোলন করা হয়েছে, শতকরা ৯ ভাগ মুনাফাসহ বর্তমানে যার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩২ হাজার ৮৫৩ টাকা। অথচ অক্ষরজ্ঞানহীন সালাম গাজী ঋণের বিষয়ে কিছুই জানেন না।

৭৩-৮৩৩ হিসাব নম্বরের গ্রাহক মো. ফারুক সরদার জানান, তিনি অক্ষরজ্ঞানহীন। ব্যাংকে না গেলেও তার নামে কীভাবে ঋণ হয়েছে, এ নিয়ে বর্তমানে তিনি মহা দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। তিনি আরও জানান, সম্প্রতি সময় তাকে ব্যাংকের নিচে দাঁড় করিয়ে দালাল নজরুল ইসলাম একটি কাগজে তার একটি টিপসই নেন। পরে দালাল নজরুল তাকে দুই হাজার টাকা হাতে দিয়ে বলে, তোমাকে সাহায্য করা হয়েছে। অতিসম্প্রতি ব্যাংক ম্যানেজারের ফোন পাওয়ার পর তিনি জানতে পারেন, তার নামে ঋণ উত্তোলন করা হয়েছে। ফারুক সরদার জানান, ব্যাংক কর্মকর্তারা তাকে না দেখে তার একটি টিপ সইতে কীভাবে ঋণ দিয়েছেন, তা প্রশ্নবিদ্ধ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সদর ইউনিয়নের চরকাউয়া এলাকার চিহ্নিত দালাল নজরুল ইসলাম এবং বাকেরগঞ্জের চরাব্দি এলাকার আলতাফ গাজী নামের দুই দালালের সহযোগিতায় তৎকালীন ব্যাংক ব্যাবস্থাপক ও ঋণ কর্মকর্তারা ব্যাপক অনিয়মের মাধ্যমে ভুয়া নাম দিয়ে কৃষিঋণের টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেছেন। দালালের মাধ্যমে ঋণের নামে প্রতারণার শিকার হওয়া ওই শাখার অসংখ্য গ্রাহক একই অভিযোগ করেছেন।

এ ব্যাপারে তৎকালীন ব্যাংক ম্যানেজার (বর্তমানে উজিরপুর শাখায় কর্মরত) মহসিন হাওলাদার বলেন, এমন ভুল হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। যদি হয় তবে ম্যানেজার হিসেবে দায়ভার তো আমাকেই নিতে হবে।

তিনি আরও বলেন, মেহেদী আল মিরাজ নামে এক কর্মকর্তা গ্রাহকদের শনাক্ত করার পর ঋণ বিতরণ কর্মকর্তা রফিকুল ইসলামের সুপারিশে সর্বশেষ আমি স্বাক্ষর করেছি।

নিজেকে নির্দোষ দাবি করে ঋণ বিতরণ কর্মকর্তা (বর্তমানে বরিশাল নগরীর বগুড়া রোড শাখায় কর্মরত) রফিকুল ইসলাম বলেন, এমন অনিয়ম হতেই পারে না। যারা অভিযোগ করেছেন, তারা মিথ্যা ও বানোয়াট অভিযোগ করেছেন।

সোনালী বাংকের বরিশাল শাখার ডিজিএম আবু বকর সিদ্দিক জানান, বিষয়টি শুনে তিনি সাহেবেরহাট শাখা থেকে সব কাগজপত্র এনে যাচাই-বাছাই করছেন। কোনো সমস্যা পেলে অবশ্যই যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে। ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তা ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন বরিশালের উপ-পরিচালক দেবব্রত মণ্ডল বলেন, বিষয়টি নিয়ে এখনও কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি। তবে ঘটনাটি গুরুতর অপরাধ। অভিযোগ পেলে তদন্ত করে অপরাধীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০