নিজস্ব প্রতিবেদক : দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ভোট বর্জনের সিদ্ধান্ত নিলেও চাপের মুখে তা পাল্টাতে বাধ্য হয় বলে জানিয়েছেন দলটির চেয়ারপারসন জিএম কাদের।
তিনি জানিয়েছেন, কোন্দল করে দল ভেঙে দেয়া হবেÑএমন পরিস্থিতি তৈরি করা হয়। এছাড়া ‘কিছু শক্তিশালী দেশ এই সরকারকে বিজয়ী করতে চায়’Ñ এমন কথা জানতে পারে দলটি। তাই ভোটে আসে।
রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে গতকাল শনিবার বর্ধিত সভায় জাতীয় পার্টির নেতা এসব কথা বলেন জিএম কাদের।
দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের পর দলের প্রথম বর্ধিত সভাটি ডাকা হয়েছে জাতীয় পার্টিতে নতুন করে ভাঙনের পরিপ্রেক্ষিতে। সাবেক সেনাশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতনের পর বারবার ভাঙনের মুখে থাকা দলটি সবশেষ ব্রাকেটবন্দি হয়েছে নির্বাচনের পর।
এরশাদপত্নী রওশন এরশাদের নেতৃত্বে আলাদা কমিটি গঠন হয়েছে, যে কমিটিতে বেশ কয়েকজন নেতার নাম রয়েছে; যারা জিএম কাদেরের নেতৃত্বে কমিটিতেও আছেন। এ অবস্থায় এই সভা ডাকা হয়।
একই দিন রওশনের কমিটির পরিচিতি সভা হওয়ার কথা ছিল। তবে গরমের কারণ দেখিয়ে সেই সভা স্থগিত করা হয়।
সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা বলেন, ‘(২০২৩ সালের) ১৬ ডিসেম্বর রাতে সবাইকে (দলের প্রার্থী) জানিয়ে দিলাম নির্বাচনে যাব না। কিন্তু ১৭ ডিসেম্বর সকালে আমার ওপরে প্রত্যক্ষভাবে ও পরোক্ষভাবে চাপ এলো। প্রত্যক্ষভাবে সেটা বলব না, কিন্তু পরোক্ষভাবে হলো, আমাদের দলের ভেতরে কোন্দল তৈরি করে দল ভেঙে দেয়া হবে।’
‘আর তখন আমার মতো ওয়েল ইনফর্মড নেতা দেশে কমই ছিল। আমি জেনে গিয়েছিলাম, কিছু শক্তিশালী দেশ এই সরকারকে জয়ী করতে চায়। তাই আমি নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। পরবর্তী সময় সরকার আমাদের সঙ্গে নেগোসিয়েশনে গেল।’
আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতার বিষয়ে জাতীয় পার্টির নেতা বলেন, ‘২৬ জনের তালিকা দেয়া হলো। কিন্তু আওয়ামী লীগ যেখানে জাতীয় পার্টির ক্যান্ডিডেট দিল সেখানে স্বতন্ত্র পাওয়ারফুল প্রার্থীও রেখেছে।’
কেবল কয়েকটি আসনে নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়েছেÑদাবি করে তিনি বলেন, ‘সরকার যাকে পাস করাতে চায়, তাকে পাস করানো হয়েছে। আমি যেই আসনে নির্বাচন করেছি, সেখানেও আমাকে হারানোর জন্য অনেক চেষ্টা করা হয়েছে। আমাকে ধ্বংস করা মানে জাতীয় পার্টিকে ধ্বংস করা।’
জাতীয় পার্টি না গেলে নির্বাচনের ‘গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না’ বলে আওয়ামী লীগ তাদের চেয়েছে বলেও মনে করেন সংসদে বিরোধী দলটির নেতা।
তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ আমাদের ব্যবহার করে একদলীয় রাজত্বের চিন্তা করেছে। তারা চেয়েছে অনুগত বিরোধী দল। তারা আমাদের গলায় পচা, গলা, মরা আবর্জনা ঢুকিয়ে দিয়ে অনুগত বিরোধী দল বানানোর চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তা আমরা হইনি।’
দলের কিছু নেতা জাতীয় পার্টির ছবি না দিয়ে আওয়ামী লীগের ছবি দিয়ে পোস্টার করে জানিয়ে জিএম কাদের বলেন, ‘এটা পার্টি মানবে না। যারা গৃহপালিত বিরোধী দল হতে চায়, চলে যান। আমরা হবো না।’
এবারের জাতীয় নির্বাচনে ঢাকা-১৮ আসনে স্ত্রী শেরীফা কাদেরকে প্রার্থী করা নিয়ে জাতীয় পার্টিতে যে বিরোধ তৈরি হয়েছে, তা নিয়েও কথা বলেন জিএম কাদের।
দলের একাংশের নেতাদের অভিযোগ, আওয়ামী লীগের কাছ থেকে এই আসনটিতে ছাড় নিশ্চিত করার জন্যই ভোটে না যাওয়ার কথা বলছিলেন জিএম কাদের। পরে এ আসনটি পেয়ে ঢাকায় দলের দুজন সংসদ সদস্যের আসন ছেড়ে দেন তিনি।
গত নির্বাচনের আগে ঢাকা-১৮ আসনে জাতীয় পার্টি প্রার্থী করে জিএম কাদেরের স্ত্রী শেরীফা কাদেরকে। নৌকা প্রতীকের প্রার্থী সরে গেলেও আওয়ামী লীগ নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী তাকে হারিয়ে দেন।
তবে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান বলেন, ‘উত্তরা আমাদের এক শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল। আমি দীর্ঘদিন এ এলাকায় রাজনীতি করেছি। ১০টি আসনের চেয়ে উত্তরার এই আসন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমি চেয়েছি দলের শক্তিশালী অবস্থানের জন্য আমার স্ত্রী এখান থেকে নির্বাচন করুক।’
দলে মনোনয়ন বাণিজ্য হয়নি দাবি করে তিনি বলেন, ‘আমাকে কমপক্ষে ১০০ জন নেতাকর্মী দিনরাত ফোন দিয়ে বলে, টাকা দেন, টাকা দেন। অথচ তারা নির্বাচনে নাই, রাজনীতির মাঠেও নাই।’
‘তারা বলেছে আমি নাকি দল বিক্রি করে দিয়েছি, আমি নাকি মনোনয়ন বাণিজ্য করেছি। কোনো মনোনয়ন বাণিজ্য করি নাই। কারও কাছ থেকে এক টাকা নিই নাই।’
আওয়ামী লীগ প্রজাতন্ত্রের জায়গায় রাজতন্ত্র কায়েম করছে বলেও মন্তব্য করেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান।
তিনি বলেন, ‘জনগণ ভোট দিতে চায় না, এটা হচ্ছে বিরাজনীতিকীকরণ। এসব করে আওয়ামী লীগ বর্তমানে রাজনৈতিক দলের চরিত্র হারিয়েছে।’
জিএম কাদের বলেন, ‘আমরা নিয়মতান্ত্রিকভাবে কথা বলে যাচ্ছি, কিন্তু আমাদের স্পেস দেয়া হচ্ছে না। ক্ষমতা সব এককেন্দ্রিক। উনার (প্রধানমন্ত্রী) ইচ্ছায় ভোট হয়। কেউ ভোট করলে উনার অনুমতি নিয়ে করতে হবে। এভাবে চললে দেশে কোনো দলই টিকবে না। এখন এমন অবস্থা করা হয়েছে যে, রাজনীতি করলে হয় ফুলের মালা না হয় ফাঁসির দড়ি গলায় নিতে হবে।’
আন্দোলন করতে নেমে বিএনপি কিছু ভুল করেছে বলেও মনে করে জাতীয় পার্টির নেতা।
তিনি বলেন, ‘আমি জানতাম বিএনপির আন্দোলনে সরকার পতন সম্ভব নয়। ১০ লাখ নয়, ১ কোটি মান্ষুও রাস্তায় নামলে নির্বাচন বন্ধ হবে না।’
২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর নয়া পল্টনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে পণ্ড হয় বিএনপির সমাবেশ। জিএম কাদের মনে করেন, সেদিন ভুল করেছে বিএনপি। গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় সমাবেশের দিন পুলিশের সঙ্গে বিএনপির নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের প্রতি ইঙ্গিত করে জিএম কাদের বলেন, ‘বিএনপি কিছু ভুল করে ফেলল। তারা ফাঁদে পড়ে গেল। নেতৃস্থানীয় লোকজন গ্রেপ্তার হলো, আন্দোলন বাধাগ্রস্ত হলো। বিএনপি আন্দোলনে পরাস্ত হয়েছে। কিন্তু তারা একটা দায় আমার ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। তারা বলে, আমি না গেলে নাকি নির্বাচন হতো না। বিএনপি-জামায়াতের নিজেদের দোষ ঢাকার জন্য আমার ওপরে দোষ দেয়।’
বর্ধিত সভায় শুভেচ্ছা বক্তব্যে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘গত নির্বাচনে আমাদের নিজেদের কিছু ভুল বুঝাবুঝি হয়েছে। আমরা প্রত্যাশিত ফলাফল পাইনি। আমাদের নেতাকর্মীদের ব্যাপক জনপ্রিয়তা থাকার পরও প্রশাসনের পক্ষপাতমূলক আচরণের কারণে জয়ী হতে পারিনি।’
কিশোরগঞ্জ-৩ আসনে অল্পের জন্য পরাজয় থেকে রক্ষা পাওয়ার কথাও তুলে ধরেন চুন্নু। তিনি বলেন, ‘আমাকেও লড়াই করে জয়ী হতে হয়েছে। আমাদের ত্যাগী কিছু নেতাকর্মী আমাদের ভুল বুঝে চলে গেছেন। আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই, এই দেশে এরশাদের প্রতিনিধিত্ব করে একমাত্র জিএম কাদের। অন্য কেউ এরশাদের প্রতিনিধিত্ব করে না। তাই যারা চলে গেছেন, তারা ভুল করেছেন।’
দলের কো-চেয়ারম্যান এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার, সালমা ইসলাম ও মুস্তাফিজুর রহমান মোস্তফা। প্রেসিডিয়াম সদস্য নাজমা আক্তার, ফখরুল ইমাম, নাসরিন জাহান রত্না, চেয়ারম্যানের স্ত্রী শেরীফা কাদের প্রমুখ বর্ধিত সভায় অংশ নেন।