শামিমা নাসরীন: দৃশ্যটা চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের। যদিও অনেক দিন পার হয়ে গেছে, কিন্তু মাঝে মধ্যে চোখের সামনে ভেসে ওঠে কাছাকাছি দৃশ্য দেখলে। শাহবাগের বারডেম হাসপাতালে স্কুটি রেখে ফুটপাত ধরে হেঁটে বইমেলায় যাচ্ছিলাম দুপুরের দিকে। তখনও ভিড় জমতে শুরু করেনি। থানার পাশের ফুটপাত ধরে যেতে যেতে দেখলাম একজন ‘পুরুষ’ দেয়ালের দিকে মুখ করে প্রস্রাব করছে। ঠিক একই সারিতে তার থেকে অল্প দূরে এক পা উঁচু করে দেয়ালে প্রস্রাব করছে আরও একটি প্রাণী, একটি কুকুর। ছবিটা ধরে রাখা দরকার ছিল কিন্তু নিজে তোলার রুচি ছিল না। এরকম দৃশ্য বোধহয় ঢাকা শহরের অনেক এলাকায় দেখা যায়। বিষয়টি ইদানীং বেশি মাথায় চাড়া দিয়ে উঠেছে; কারণ এখন সপ্তাহের ছয়টা দিন দুই বেলা আমাকে কারওয়ান বাজারের ইটিভি-এনটিভির ‘মূত্রসাগর’ পাড়ি দিতে হয়। প্রখর রৌদ্রস্নাত দিনেও এ গলির খাল ভরা যৌবনা, আর বর্ষা বা বৃষ্টির দিন হলে তো কথায় নেই।
হাতিরঝিলে পানিতে ড্রেনের গন্ধ পাওয়া যায়। তবে এ গলির গন্ধের কোনো মৌলিকতা নেই। মৌলিকতা নেই বলছি এ কারণে, এখানে প্রস্রাব, বিড়ি-সিগারেট, একই সঙ্গে বিভিন্ন খাবার-পানীয় আর সন্ধ্যার পর যোগ মহাদেবের প্রসাদ অর্থাৎ গঞ্জিকার গন্ধ। মানে সব মিলিয়ে যে উৎকট গন্ধের সৃষ্টি হয়, তার নাম দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। বড়ই অদ্ভুত লাগে যখন দেখি কোনো লোক প্রাকৃতিক কর্ম সারতে সারতে আবার পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখে কে যাচ্ছে। আরও অদ্ভুত লাগে এখানে, একাধারে প্রস্রাব করছে কিছু লোক তার অল্প দূরেই আবার খাবার খাচ্ছে আরেকদল। কেউ কারও দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। যার যার কাজ যে যে করে যাচ্ছে। অথচ খাবার জায়গার পাশেই শরীরের এমন বর্জ্য ত্যাগ নিয়ে কেউ কোনো প্রতিবাদও করে না। যেন এটি খুবই স্বাভাবিক। প্যান্টের মধ্যে শার্ট গুঁজে দেওয়া, পায়ে জুতা পরা ফিটফাট ভদ্রলোকদেরও মাঝে মধ্যে এ গলিতেই দাঁড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। অথচ এ গলি দিয়ে বহু কর্মজীবী-অফিসগামীদের যাতায়াত করতে হয়। অফিসের কাজের চাপে হাঁপিয়ে ওঠা শরীর-মন জুড়াতে এখানেই বসে কত কতজন। তারাও চাইলে তো পারে এখানকার পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে। এ গলি দিয়ে হেঁটে অফিসে এসে ৮ ঘণ্টা সময় ব্যয় করা যে কত কষ্টকর তা কীভাবে বোঝাব সে ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না।
শুধু কারওয়ান বাজারের এ গলিই নয়, রাজধানীর অনেক গলি ও ফুটপাত ‘মূত্রবাহিনী’র দখলে। রাজধানীর কয়টা ফুটপাত আছে, যেখানে পথচারীরা হেঁটে যেতে পারে নির্বিঘেœ? কোথাও মূত্রবাহিনীর দখলে, কোথাও দোকানি-হকারের দখলে, কোথাও আবার পুরোটায় মোটর মেকানিকদের দখলে, কোথাও আবার আসবাবের দোকনদারদের দখলে; আর যেখানে কারও দখল নেই, সেখানে মোটরসাইকেল চালকদের দৌরাত্ম্য তো রয়েছেই! তা নিয়ে লিখে শেষ করা যাবে না। কিন্তু এ থেকে তো মুক্তি দরকার। আমরা নিরাপদে নির্বিঘ্নে ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে চাই। দখলদারদের থেকে ফুটপাত মুক্ত না হলে সমস্যা বহুমুখী। বেশ কিছুদিন থেকে ধরে দেখছি রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ স্কুলের বাচ্চারাও ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারের জন্য পথচারীদের অনুরোধ করছে। তাহলে ফুটপাতগুলো হাঁটার উপযোগী করার কোনো চেষ্টা কেন দেখা যাচ্ছে না। যাই হোক শুরুর প্রসঙ্গে আবার ফিরছি, ফুটপাত, অলিগলি, চিপাচাপি মূত্রবাহিনীর কবল থেকে রক্ষা করতে প্রশাসনকেই পদক্ষেপ নিতে হবে। সবকিছু আইন করে হয় না। কিন্তু বুদ্ধি দিয়েও তো অনেক কিছু করা সম্ভব হয়।
কয়েক মাস আগে থেকেই ধর্মমন্ত্রী মতিউর রহমানের একটি ভিডিওচিত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যেখানে দেখা যাচ্ছে, ফুটপাত বা দেয়ালের আড়ালে প্রস্রাব করতে গেলেও, তা না করে ফিরে যাচ্ছে তারা। কারণ সামনে আরবি হরফে কিছু লেখা আছে। আসলে সেখানে আরবিতে লেখা আছে ‘এখানে প্রস্রাব করা নিষেধ’, যা আগে বাংলায় লেখা ছিল। নিজের ভাষা তাই কারও গায়ে লাগত না। অথচ আরবি হরফ দেখেই শ্রদ্ধায় সবার মাথা নুয়ে গেল যদিও বার্তাটি একই ছিল। ভিডিওটি দেখে প্রথমে হাসি পেয়েছিল ধর্মান্ধ বাঙালির মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা চিন্তা করে। একই সঙ্গে ধর্মমন্ত্রীর এসব লোকের মনস্তত্ত্ব পড়ার ক্ষমতা দেখেও বিস্মিত হয়েছি। তিনি কিন্তু ঠিকই ধরেছিলেন, বার্তা যাই হোক আরবি লেখা দেখলেই মূত্রবাহিনী কাবু হবে। কোথাও যদি আরবি হরফ দিয়ে লেখা হয় ‘এখানে প্রস্রাব করতেই হবে’ তবুও তারা সরে যাবে। বুদ্ধির কাছে বোকাদের বড় ধরনের পরাজয়।
এই একই পদ্ধতি অথবা অন্য কোনো বুদ্ধি করেও কি রাজধানীতে স্রোতে ভেসে যাওয়া ফুটপাত, গলি, বসার স্থান বা বিভিন্ন পার্কগুলো এদের হাত থেকে রক্ষা করা যায় না? তাহলে বেঁচে যেতাম আমরা পথচারীরা। অন্তত জ্যামের এ শহরে পথচারীরা তো একটু শান্তিতে হেঁটে যেতে পারত। কর্মজীবীরা ক্লান্তি জুড়ানোর জন্য অফিসের পাশের গলিতে একটু পরিষ্কার পরিবেশে বসে চায়ে দুটো চুমুক দিতে পারত। ক্লান্ত-শ্রান্ত পথচারী বা কর্মজীবী কিংবা দিনমজুর পার্কে বসতে পারতেন নির্মল বাতাস সেবন করতে। কিন্তু বাস্তবতা পুরো বিপরীত। ফার্মগেটের আনোয়ারা পার্কের গাঘেঁষে যে ফুটপাত তাতে ভাটার টান দেখা যায় না বললেই চলে! সব সময়ই প্রায় জোয়ার বয়ে যায়। শুধু মূত্র নয়, রাজধানীর ফুটপাতে মলও দেখা যায় অহরহ। এদিকে কারওয়ান বাজারের পান্থকুঞ্জ পার্কের অবস্থাও একই। সেখানেও মলমূত্র সবাই ত্যাগ করে। দৈনিক বাংলা মোড়ের শিপিংয়ের ভবনটির পাশের ফুটপাতে ছোট ছোট কয়েকটি খাবারের দোকান রয়েছে। সেখানে বসে খাচ্ছে কিছু লোক। আবার তারই পেছন দিয়ে যে রাস্তাটি গেছে সেখানেই দিনের আলোতে মলমূত্র ত্যাগ করছে আরেক দল। আরও অবাক বিষয় হলো, ঢাকা শহরের ওভারব্রিজের ওপরও মনুষ্য বর্জ্য পাওয়া যায়! একটা সময় কারওয়ান বাজারের প্রজাপতির গুহা নামে আন্ডারপাসটিও মূত্রবাহিনী ও মাদকবাহিনীর দখলে ছিল। কিন্তু সেটা এখন তাদের দখলমুক্ত করা হয়েছে। একইভাবে রাজধানীর অন্যান্য স্থানও পরিচ্ছন্ন করা সম্ভব নয় কি?
এজন্য শুধু পথচারীদের দোষ দিয়েও লাভ নেই। পর্যাপ্ত গণশৌচাগারের অভাব রয়েছে রাজধানীতে। এটিও ফুটপাত অপরিচ্ছন্ন থাকার বড় কারণ। ধরা যাক ফার্মগেট, বাংলামোটর, মগবাজার বা কারওয়ান বাজারের কোনো এক পথচারীর প্রাকৃতিক কর্মের বেগ পেল; তিনি নিশ্চয় হেঁটে সাতরাস্তার শৌচাগারে যাবেন না। যদি অফিসগামী হন তাহলে অফিসে গিয়েই হয়তো সারবেন। কিন্তু একজন দিনমজুর কোথায় যাবেন? এসব থেকে রক্ষা পেতে হলে প্রশাসনকে নড়ে চড়ে বসতে হবে। পর্যাপ্ত পরিমাণ গণশৌচাগার ছাড়া কোনোভাবেই এ সমস্যার সমাধান হবে না। শুধু তাই নয়, সাতরাস্তায় যে শৌচাগার রয়েছে তাতে প্রস্রাব করলে দুই টাকা এবং পায়খানা করলে পাঁচ টাকা নেওয়া হয়। পাঁচ টাকা দিয়ে একজন দিনমজুরের পক্ষে কয়বার সেখানে যাওয়া সম্ভব? এছাড়া ফুটপাত, পার্ক, গলি, সড়কদ্বীপে প্রস্রাব-পায়খানার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী ভাসমান জনগণ। এদের পুনর্বাসন না করলে মলমূত্র মুক্ত ঢাকা শহর সম্ভব নয়। ঢাকায় প্রায় প্রত্যেকটি ফ্লাইওভারের নিচে ভাসমান লোকজন রাতযাপন করে। পাশাপাশি শরীরের বর্জ্যও ত্যাগ করে।
রাজধানীর দর্শনীয় ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত স্থান হাতিরঝিল। রৌদ্রস্নাত দিনের দুপুরে যদি কেউ হাতিরঝিলে যান, তাদের ৫০ শতাংশের বমি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এত টাকা খরচ করে একটি প্রকল্প করল অথচ সেখানে গাছের নিচের ঘাসে বসে নির্মল বায়ু সেবন আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের কোনো উপায়ই নেই। সেখানে শুধু পানির গন্ধ নয়, এর সঙ্গে মলের গন্ধ যুক্ত হয়ে ভয়ঙ্কর রকমের উৎকট গন্ধের সৃষ্টি হয়। সরকার কোটি কোটি টাকা খরচ করে যে প্রকল্প নির্মাণ করছে, তা রক্ষণাবেক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেই। এসব রক্ষণাবেক্ষেণের সঠিক পদ্ধতি থাকলে তো এমনিতেই পরিষ্কার থাকবে। যেভাবেই হোক আমরা ঢাকায় বসবাস করা লোকজন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ঢাকা চাই। আমরা নির্মল প্রকৃতি সঙ্গে নিয়ে বাঁচতে চাই। আর এজন্য প্রশাসনকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না হলে কয়েক বছর পর হয়তো ঢাকার রাস্তায় হেঁটে চলা সম্ভব হবে না।
গণমাধ্যমকর্মী