নাদের হোসেন ভূঁইয়া: একসময় এলাকায় কোনো শিক্ষার্থী পাবলিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগ পেলে তাকে সবাই দেখতে আসত। গণমাধ্যমকর্মীরা আসত সাক্ষাৎকার নিতে। কৃতী শিক্ষার্থীর কাছে জানতে চাওয়া হতো, কীভাবে সে পড়ালেখা করল, তার অনুপ্রেরক কে। আরও কত প্রশ্ন। বাবা-দাদার কাছ থেকে শোনা কথা হলেও এটিই বাস্তব। এখন জিপিএ-৫ ধারীর সংখ্যা লাখ লাখ। তাই কেউ জিপিএ-৫ পেলে তার বাসায় সাংবাদিক আসে না। তাকে গণমাধ্যমে দেখানো হয় না। দুঃখজনক হলো, এমন অনেক জিপিএ-৫ ধারী রয়েছে জিপিএ এর পূর্ণরূপ জানে না। প্রকৃতপক্ষে অনেক জিপিএ-৫ ধারী জিপিএ-৫ পাওয়ার যোগ্যতা রাখে না। তাও কভিড কিংবা বিভিন্ন কারণবশত তাকে জিপিএ-৫ পাওয়ার সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু বাস্তব জীবনে এসে ওই এ প্লাসধারী কতটুকু গ্রহণযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারছে?
আমার প্রতিবেশী এক দাদা বড়জোর দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছিলেন। এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার সৌভাগ্য তার হয়নি। কিন্তু উনি এত মেধাবী ছিলেন যে, কোনো ইংরেজি শব্দের অর্থ বলে দিতে পারতেন নিমিষেই। ইংরেজিসহ সব বিষয়ে তার দক্ষতা সবাইকে অবাক করত। শিশুকালে সৌভাগ্য হয়েছিল তার সান্নিধ্যে আসার। একদিন অনেকগুলো ইংরেজি শব্দের অর্থ জিজ্ঞাসা করেছিলাম। প্রতিটি শব্দের সঠিক উত্তর পেয়ে আমি অবাক হই। অথচ এই শব্দগুলো উত্তর এখনকার অনার্স সম্পন্ন করা অনেক শিক্ষার্থীও পারবেন না।
২০২১ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় রেকর্ড পাসের হার ও জিপিএ-৫ পাওয়ায় আনন্দ-উল্লাসে ভাসছেন শিক্ষার্থীরা। তাদের মনে চিন্তার মেঘও জমতে শুরু করেছে। কিছুদিন পরই শুরু হবে ভর্তিযুদ্ধ। আর এতে জিপিএ-৫ পেয়েও প্রায় দেড় লাখ শিক্ষার্থী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে।
ফল বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, দেশের ৩৯টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন রয়েছে ৩৯ হাজারের বেশি। আর এবার জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ৮৯ হাজার। ফলে জিপিএ-৫ পেয়েও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাবেন না ১ লাখ ৫০ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী।
তাছাড়া এবার পরীক্ষায় পাস করেছেন ১৩ লাখ ৭১ হাজার ৬৮১ জন। আর পাবলিক-প্রাইভেট মিলিয়ে আসন রয়েছে ৪ লাখের বেশি। ফলে এক্ষেত্রেও বঞ্চিত হবেন শিক্ষার্থীরা।
প্রতিটি পাবলিক পরীক্ষায় ভালো নম্বর পেয়ে পাস করার পর এই তরুণরা যখন চাকরির বাজারে যায় তখন তারা বুঝতে পারে এই জিপিএ-৫ এর মূল্য কী। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় দেখা যায়, স্বনামধন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের ৬৬ শতাংশ, অর্থাৎ দুই-তৃতীয়াংশই বেকার। ওই প্রতিষ্ঠানের মাত্র ২১ শতাংশ শিক্ষার্থী স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর শেষ করে চাকরি পান এবং মাত্র ৩ শতাংশ স্ব-উদ্যোগে কিছু করছেন। দুই বছর আগেও বিশ্বব্যাংক একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর জরিপ করেছিল। তাতেও দেখা গেছে, স্নাতক পাস করা শিক্ষার্থীদের ৪৬ শতাংশ বেকার, যারা তিন বছর ধরে চাকরি খুঁজছেন। সরকারি উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের গবেষণায় দেশে মাধ্যমিক থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী তরুণদের এক-তৃতীয়াংশ পুরোপুরি বেকার বলে যে তথ্য উঠে এসেছে, তাতে আমরা উদ্বিগ্ন না হয়ে পারি না। এই গবেষণায় দেখা যায়, শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে সম্পূর্ণ বেকার ৩৩ দশমিক ৩২ শতাংশ। বাকিদের মধ্যে ৪৭ দশমিক ৭ শতাংশ সার্বক্ষণিক চাকরিতে, ১৮ দশমিক ১ শতাংশ পার্টটাইম বা খণ্ডকালীন কাজে নিয়োজিত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি অনুযায়ী, দেশে শিক্ষিত মানুষের মধ্যেই বেকারের হার বেশি, যেখানে ৪৭ শতাংশ শিক্ষিতই বেকার। অন্যদিকে দেশে প্রতি বছর শ্রমশক্তিতে যোগ হচ্ছেন ২০ লাখ মানুষ। কিন্তু সেই অনুপাতে কর্মসংস্থান হচ্ছে না। ফলে বড় একটি অংশ বেকার থেকে যাচ্ছেন। তাছাড়া, করোনার দাপটে কাজ হারিয়েছে অসংখ্য শিক্ষিত তরুণ। বিশ্বেও শিক্ষিত বেকার মানব সম্পদ নেহায়েত কম নয়। সম্প্রতি প্রকাশিত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ‘ওয়ার্ল্ড এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল আউটলুক-ট্রেন্ডস ২০২২’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এক তথ্য বলা হয়েছে, করোনা মহামারিতে চলতি বছর বিশ্বে বেকার মানুষের সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ২০ কোটি ৭০ লাখ। এই সংখ্যা কভিড মহামারি শুরুর আগের বছর ২০১৯ সালের চেয়ে ২ কোটি ১০ লাখ বেশি।
দেশে উচ্চশিক্ষা অর্জনের হার যেমন বাড়ছে, তেমন উচ্চশিক্ষিতদের বেকারত্বের হার বৃদ্ধি প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। লাখ লাখ শিক্ষিত তরুণ দেশের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েও চাকরি না পেয়ে হতাশায় ভুগছেন। শিক্ষিত বেকার তরুণ-তরুণীর কাছে চাকরি হয়ে উঠেছে ‘সোনার হরিণ’। দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদ ও শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, প্রধানত শিক্ষার নি¤œমানই এর জন্য দায়ী। মানহীনতার পাশাপাশি প্রশিক্ষণের অভাব, দক্ষ জনবলের ঘাটতি, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চাহিদা অনুযায়ী উপযুক্ত শিক্ষা দিতে না পারা ও শিক্ষায় কম বিনিয়োগ ইত্যাদি এর কারণ। ‘বর্তমানে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি তথা জিডিপি যে হারে বাড়ছে, সে অনুযায়ী দেশে কর্মসংস্থান হচ্ছে না। শ্রমবাজারের তুলনায় চাকরির বাজার ছোট হওয়ায় সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারীরাও চাকরি পাচ্ছেন না। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ বেকারত্ব কমাতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশের চিত্র অনেকটাই বিপরীত। এ দেশে শিক্ষিতের বেকার হওয়ার আশঙ্কা অশিক্ষিতদের তুলনায় বেশি। কারণ অশিক্ষিত বেকার জনগোষ্ঠী যেকোনো কাজ করতে সক্ষম। কিন্তু শিক্ষিত একজন তরুণ চাইলেই যেকোনো কাজ করতে পারেন না। তাই শিক্ষিত জনশক্তির জন্য কর্মসংস্থান বর্তমান একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এখনই সময় শিক্ষব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর। পাশ কিংবা জিপিএ মুখ্য নয় বরং প্রতিটি শিক্ষার্থী যেন প্রকৃত শিক্ষিত জনগোষ্ঠী হয়ে উঠতে পারে সেটি আমাদের বড় লক্ষ্য হওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি সর্বক্ষেত্রে কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যেসব শিক্ষার্থী কারিগরি দিকে যেতে ইচ্ছুক তাদের সেই দিকে উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। সেই সঙ্গে শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরও সৃজনশীল করতে হবে।
শিক্ষার্থী, ব্যবস্থাপনা বিভাগ
ফেনী সরকারি কলেজ