Print Date & Time : 20 June 2025 Friday 9:32 pm

বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাজেট বাস্তবায়ন অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং

নিজস্ব প্রতিবেদক:বর্তমান প্রেক্ষাপটে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট বাস্তবায়ন অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। তবে বাজেটকে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে হলে বাজেট ব্যবস্থাপনার গতিশীলতা, করনীতি সংস্কার, কর

ব্যবস্থার অটোমেশন, কর সংগ্রহে সামগ্রিক সিস্টেম লস কমানো এবং কর প্রশাসনের সক্ষমতা বৃদ্ধি তথা জনগণের যথাযথ সেবা প্রদানে আরও সুযোগ রয়েছে বলে মনে করে মেট্রোপলিটান চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, ঢাকা (এমসিসিআই)। গতকাল বৃহস্পতিবার সংগঠনের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক বাজেট প্রতিক্রিয়ায় বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে।

এমসিসিআইর সভাপতি মো. সায়ফুল ইসলাম বাজেটকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, এমসিসিআই মনে করে, ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতির কারণে রপ্তানি বাজার সংকুচিত হওয়া; রাশিয়া-ইউক্রেন চলমান যুদ্ধ; স্মার্ট বাংলাদেশের রূপরেখা বাস্তবায়ন এবং ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীতকরণের সময় বাজেট প্রস্তুত করা অর্থমন্ত্রীর জন্য একটি চ্যালেঞ্জিং কাজ ছিল। ধারণা করা যাচ্ছে যে, ‘আয়কর আইন, ২০২৩’ অতিসত্বর বাজেট অধিবেশনে উত্থাপিত হতে যাচ্ছে। তবে সংসদে উত্থাপনের পূর্বে অংশীজনদের সঙ্গে বিশেষ করে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের সঙ্গে চূড়ান্ত মতামত দেয়ার জন্য শেয়ার করা আবশ্যক বলে চেম্বার মনে করে। বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা বর্তমান ২০২২-২৩ অর্থবছরে নির্ধারিত ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা থেকে ১৬.২০ শতাংশ বৃদ্ধি করে আসন্ন ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ভ্যাট কর্তৃপক্ষকে ১ লাখ ৬৩ হাজার ৮৩৭ কোটি, আয়কর কর্তৃপক্ষকে ১ লাখ ৫৩ হাজার ২৬০ কোটি এবং শুল্ক কর্তৃপক্ষকে ১ লাখ ১২ হাজার ৯০৩ কোটি টাকা সংগ্রহ করতে হবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাজেট বাস্তবায়ন অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। তবে বাজেটকে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে হলে বাজেট ব্যবস্থাপনার গতিশীলতা, করনীতি সংস্কার, কর ব্যবস্থার অটোমেশন, কর সংগ্রহে সামগ্রিক সিস্টেম লস কমানো এবং কর প্রশাসনের সক্ষমতা বৃদ্ধি তথা জনগণের যথাযথ সেবা প্রদানে আরও সুযোগ রয়েছে বলে চেম্বার মনে করে। এমসিসিআই সবসময় কর প্রশাসনে অর্থবহ কাঠামোগত পরিবর্তনের পরামর্শ দিয়ে আসছে, যেন কর প্রশাসন যথাযথভাবে রাজস্ব সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়। বিদ্যমান কাঠামোয় উচ্চ আয়ের অনেক যোগ্য প্রতিষ্ঠানও করের আওতার বাইরে থেকে যাচ্ছে, যখন নিয়মিত কর প্রদানকারী ব্যক্তি বা ব্যবসায়ীদের ওপর আরও বেশি করে করের বোঝা চাপানো হচ্ছে। বিষয়টি সঠিকভাবে সমাধা হওয়া প্রয়োজন।

২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা (যা জিডিপির ৫.২%)। মোট ঘাটতির বাজেটের মধ্যে ১ লাখ ৬ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা বাইরের উৎস থেকে এবং ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সংস্থান করা হবে। এই ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকার মধ্যে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা ব্যাংক খাত থেকে, ২৩ হাজার কোটি টাকা সঞ্চয়পত্র এবং অন্যান্য নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতের উৎস থেকে সংগ্রহ করা হবে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) প্রদত্ত কর ব্যবস্থার সংস্কারের শর্তাবলির কারণে চূড়ান্ত বাজেট ঘাটতি বাড়িয়ে তুলতে পারে। সুতরাং এমসিসিআই সরকারি প্রকল্পের অর্থায়নের ক্ষেত্রে ব্যয় সীমিত করার জন্য যথাযথ আর্থিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার পরামর্শ দিচ্ছে।

ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা হলো ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট (১ লাখ ১৫ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা) থেকে ১৪ দশমিক ৭০ শতাংশ বেশি। ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে সরকার দুই ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে পারে। প্রথমত, ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি অর্থনীতিতে একটি পৎড়ফিরহম ড়ঁঃ প্রভাব তৈরি করতে পারে; যার ফলে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগকারীদের জন্য তহবিলের ঘাটতি দেখা দিতে পারে। দ্বিতীয়ত, সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়াতে পারে বলে এমসিসিআই মনে করে।

চেম্বার মনে করে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে গরিবমুখী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির ওপর অধিকতর নজর দেয়া উচিত। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর মাধ্যমে দরিদ্র মানুষদের সহায়তার পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করা উচিত। প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর জন্য প্রস্তাবিত বরাদ্দ ১ লাখ ২৬ হাজার ২৭২ কোটি টাকা, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১ লাখ ১৩ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা ছিল, এই খাতে ১২ হাজার ৬৯৬ কোটি টাকা বাড়ানো হয়েছে। এমসিসিআই এই খাতে বরাদ্দ যৌক্তিকভাবে বাড়ানো প্রয়োজন মনে করছে।

এমসিসিআই বিশ্বাস করে, অনুন্নত যোগাযোগব্যবস্থা ও অবকাঠামো, ইউটিলিটির সুষম বণ্টনব্যবস্থা এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য এখনও প্রধান অন্তরায় হিসেবেই থাকছে। এছাড়া দুর্বল রাজস্ব আদায় ব্যবস্থা (বর্তমান অর্থবছরের জুলাই-মার্চ মধ্যে ৬০ দশমিক ৯৫ শতাংশ সংগৃহীত) এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বাস্তবায়ন (বর্তমান অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল পর্যন্ত ৫০ দশমিক ৩৩ শতাংশ বাস্তবায়িত) অর্থনীতির জন্য উদ্বেগের কারণ। সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য উচ্চ আমদানি প্রবণতা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বিপর্যয় বিবেচনা করে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। বিদ্যুৎ, গ্যাস ও সারের দামে উচ্চ ভর্তুকি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, অন্যথায় ভর্তুকি ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে আরও বৃদ্ধি পাবে বলে এমসিসিআই মনে করে।

করপোরেট কর হারের ক্ষেত্রে নগদ লেনদেনের শর্তাবলি পুনর্বিবেচনা বিষয়ে কোনো প্রস্তাবনা না থাকায় এমসিসিআই হতাশা ব্যক্ত করছে। বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতির বিবেচনায় এই ধরনের শর্তাবলি সামঞ্জ্যপূর্ণ নয়। অপরদিকে, চেম্বার কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে এমন নির্মাণ, অবকাঠামো ইত্যাদি পরিসেবাতে উৎসে কর কর্তনের (টিডিএস) হার কমানোর পরামর্শ দিচ্ছে। তদুপরি বাংলাদেশে কার্যকরী করহার অত্যন্ত বেশি। উৎসে কর কর্তনের (টিডিএস) হারকে যৌক্তিকীকরণের মাধ্যমে কার্যকরী করহার কমানোর জন্য যুগোপযোগী একটি পদক্ষেপ চেম্বার আশা করে।

করমুক্ত আয়কর সীমা ব্যতিরেকে সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে ন্যূনতম কর দুই হাজার টাকা প্রদান করে আয়কর রিটার্ন জমা দেয়া, আয়কর দাতাদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। একই সঙ্গে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতকে (এসএমই) প্রাতিষ্ঠানিক খাতে রূপান্তরের প্রক্রিয়াকে এই করহার বাধাগ্রস্ত করবে বলে চেম্বার মনে করে। সুতরাং অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতসমূহে এই করহার পুনঃবিবেচনা করার জন্য এমসিসিআই পরামর্শ দিচ্ছে। অপরপক্ষে, কর আদায়করণকে সহজীকরণের লক্ষ্যে ‘কর প্রতিনিধি’ নিয়োগ আয়কর আইনে সন্নিবেশিত বিধান বাস্তবায়নের পূর্বে বিস্তারিত বিশ্লেষণ জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে করার জন্য এমসিসিআই পরামর্শ প্রদান করছে। কর প্রতিনিধিগণকে স্বচ্ছতার সঙ্গে প্রয়োজনীয় ব্রিফিং, প্রশিক্ষণ ও নির্দেশনা দেয়া প্রয়োজন বলেও এমসিসিআই মনে করছে। অন্যথায় করপ্রদানকারী ও কর আদায়কারীর মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটার আশঙ্কা রয়েছে।