Print Date & Time : 17 June 2025 Tuesday 4:35 pm

বর্তমান ভুল রাজনীতির মাশুল কেন দেবেন জাতীয় নেতারা

মোহাম্মদ আবু নোমান: দেশের তরুণ, যুবক, ছাত্র ও শিক্ষক সমাজের মধ্যে থাকতে হবে দেশ গড়ার ও দেশ নির্মাণের কমিটমেন্ট। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক পার্টিগুলো দলীয় সমর্থক ও কর্মীদের মানসিকতা থেকে শিক্ষা ও নৈতিকতার পাঠকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে সদা সচেষ্ট থেকেছে। ১৫ বছর ধরে আমাদের পুরো সমাজটাই হয়ে গিয়েছিল একটি রাজনৈতিক দলের ইচ্ছার প্রতিফলন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও রাজাকারের ধুয়া তুলে দেশকে খণ্ডিত করে ফেলা হয়েছিল। কিশোর, তরুণ ও ছাত্রদের মেধা ও দেশ গড়ার ইচ্ছা পঙ্গু করে এক রাজনৈতিক ও পার্টিনির্ভর পরিমণ্ডলকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছিল। তারা বঙ্গবন্ধুর নামটি ব্যবহার করেছে নিজের ওপরে ওঠার সিঁড়ি হিসেবে। বড় দুই দলই নোংরা রাজনীতির খেলায় কখনও বঙ্গবন্ধুকে আবার কখনও জিয়াউর রহমানকে অসম্মান করেছে।

গত ১৫ বছরে প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে রাজাকারের বাহানা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুকে পতাকা বানিয়ে এক নাগারে তিন টার্ম অন্যায়ভাবে ক্ষমতা ধরে রাখা এবং পরিশেষে পালিয়ে দেশত্যাগে বাধ্য হওয়ার সর্বশেষ পরিণতিতে দেশব্যাপী বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিফলক, তার প্রতিকৃতি ও ভাস্কর্যের ওপর অভাবনীয় ও অকল্পনীয় অবমাননাকর খেলার দায়ভার কার? ১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর মর্মান্তিক মৃত্যু এবং ২০২৪ সালে এত অসম্মান বঙ্গবন্ধুর প্রাপ্য ছিল কী? স্তাবকেরা নিজেদের অবৈধ, অন্যায় ও অনৈতিক কার্যসাধন এবং অযোগ্য ও দুর্নীতিপরায়ণরা নিজ ক্যারিয়ার ডেভেলপে বঙ্গবন্ধুকে মহা থেকে মহামানব বানানোর কাজে লেগে গেল। কাদা-মাটির দেশে বঙ্গবন্ধু বহু ত্যাগ ও তিতিক্ষা নিয়ে আন্দোলন করে মানুষের হƒদয়ে ছিলেন। তাঁকে কাদা-পানি-মাটি থেকে যখন শততলায় তুলে ধরলেন, তখনই মানুষের হƒদয়ের আসন থেকে সরে গেলেন বঙ্গবন্ধু। এটা তাঁর প্রিয় দলেরই তৈরি করা অ্যাচিভ পারফরম্যান্স!

দেশ নির্মাণে বঙ্গবন্ধু যুগসৃষ্টিকারী মহান ব্যক্তিত্ব। স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার হিসেবে তার নাম অটুট থাকবে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিশালত্ব নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। দুর্ভাগ্য বঙ্গবন্ধুর, নিজের হাতে গড়া প্রিয় দল তাঁর এই বিশালত্ব সঠিকভাবে জানতে ও বুঝতে পারেনি। ত্যারামি-ভ্যারামি করে আওয়ামী লীগ বারবার এ পাহাড়সমান ব্যক্তিকে ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির মানসে।
বাংলাদেশের নাম এলে বঙ্গবন্ধুর নাম সামনে আসবেই। সঙ্গে শহিদ জিয়াউর রহমান, মওলানা ভাসানী, এ কে ফজলুল হক, তাজউদ্দীন আহমদসহ অনেকের নাম সামনে না আসার কোনো সুযোগ নেই। দেশের জন্য তাদের অবদান অস্বীকার করার উপায় আছে কি? আমরা বরাবরই দেখছি যখন যে দল ক্ষমতায় এসেছে, কখনও বঙ্গবন্ধুকে, কখনও শহিদ জিয়াউর রহমানকে খাটো করার চেষ্টা করেছে। বাংলাদেশকে যদি হিংসা-বিদ্বেষ-সংঘাতের পথ থেকে বের হয়ে সমৃদ্ধির পথে চলতে হয়, তাহলে ইতিহাসে যার যা প্রাপ্য সেটা স্বীকার করতেই হবে।

সীমালঙ্ঘন বা বাড়াবাড়ি করা মোটেই কাম্য নয়। কেননা এর পরিণাম কখনও শুভ হয় না। কারও প্রতি কথাবার্তায় বা আচার-আচরণে অন্যায়, জুলুম বা নির্যাতন করা এমনকি তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা সীমালঙ্ঘনের মধ্যেই পড়ে। হিংসা-বিদ্বেষ বা অহংকার করাও সীমা লঙ্ঘনের শামিল। মানুষ যখন অর্থকড়ি বা ক্ষমতার দম্ভে আত্মহারা হয়ে যায়, তখন তার পক্ষে যে কোনো অন্যায়-অপকর্ম করা কঠিন হয় না। নিজের সীমা-পরিসীমা সম্পর্কে তখন সে হয়ে পড়ে বেহুঁশ বা অসচেতন।

শিক্ষা, মেধা, ধৈর্য, গবেষণা ও সমাজ নির্মাণের কোনো অবস্থান দেশে আছে কি? মেধাকে কাজে লাগানোর জন্য কোনো রাজনীতি দেশে নেই? সারাদেশই যেন হয়ে উঠেছিল মেধাহীন ও অপরাজনীতিসর্বস্ব তরুণ-তরুণীদের বিচরণ ভূমি। এ প্রজšে§র পড়ুয়া ও পরীক্ষায় ভালো করা দেশের সবচেয়ে উজ্জ্বল মেধাবীরা জাপান, জার্মানি, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমায়। বলতেই হবে বাংলাদেশকে মেধাদুর্বল করার জন্য শতভাগ দায়ী আমাদের দেশের চলমান অপরাজনীতি। ১৮ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে বিএনপি। বিএনপি মনে করে, নির্বাচন হলেই তারা ক্ষমতায় যাবে। যদিও শেষ পর্যন্ত ক্ষমতার বিন্যাস কী হবে, সেটা এখনই বলা যায় না। তাদের কর্মীদের মধ্যেও ক্ষমতায় যাওয়া নিয়ে তাড়াহুড়া লক্ষণীয়। তবে রাষ্ট্রক্ষমতায় না বসলেও রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনা করা হয় যেসব মাধ্যমে, সেগুলোর দখল মোটামুটি বিএনপির সমর্থকেরা নিয়েছেন বা নিচ্ছেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দলনিরপেক্ষ হলেও প্রশাসন এখন বিএনপির নিয়ন্ত্রণে, এটা অস্বীকার করা যাবে না।

২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের তিনটি ভোটারবিহীন প্রহসনের নির্বাচন এবং স্বৈরাচারী কায়দায় ক্ষমতা ধরে রেখে আওয়ামী লীগ মূলত দেশে অপরাজনীতি ও যুদ্ধ ঘোষণা দিয়ে রেখেছিল। সেই যুদ্ধে হেরে পালিয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগ ও তাদের দোসররা ছাড়া প্রায় সবাই আজ রাষ্ট্র সংস্কারের বিষয়ে একমত। সারা বিশ্ব অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখেছে চর দখলের মতো ভোটকেন্দ্র দখলের নির্বাচন, যা শেখ হাসিনাকে ক্রমে ক্রমে তৈরি করেছে কর্তৃত্ববাদী স্বৈরশাসক হিসেবে। দেশে এককথায় চালু হয়েছিল অনেকটা একদলীয় শাসন, যার চূড়ান্ত পরিণতি বিশ্বব্যাপী দেখেছে ৫ আগস্ট। জুলাই-আগস্ট মাসে বাংলাদেশে যা হয়েছে, তা একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন। রাষ্ট্র সংস্কার ও রাজনৈতিক সংস্কার নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। রাষ্ট্র গঠন ও সংস্কার শুরু করার এখনই সুবর্ণ সময়। এ রকম সুযোগ ও সময় ইতিহাসে বারবার আসে না! বলতেই হবে, আমরা এখন একটা সম্ভাবনার মধ্যে আছি।

সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে কীভাবে সর্বস্তরে সংস্কার করা হবে, সেটাই এখন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমরা চাই মেধাভিত্তিক প্রশাসন। পদোন্নতি দিতে হবে যাচাই-বাছাই করে, নইলে মেধার মূল্য থাকে না। যারা বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগে পদোন্নতিবঞ্চিত ছিলেন, যাদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে মামলা চলছে, যাদের যোগ্যতা নেই, তাদেরও ঢালাওভাবে পদোন্নতি দেয়া ঠিক হবে না। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, প্রশাসন চলবে দক্ষ ও মেধাবী কর্মকর্তাদের দ্বারা। এত দিন তো কে নিজ রাজনৈতিক দলের প্রতি অনুরক্ত, এরকম দলকানা ও দলদাসদের পদায়নের ক্ষেত্রে বিবেচ্য ছিল। সরকারি কর্মকর্তার একটাই পরিচয়Ñতিনি প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। কোন দল কখন ক্ষমতায় এলো, সেটির ওপর তার কাজ নির্ভর করে না। কিন্তু আমাদের প্রশাসনে ক্ষমতাসীনরা সব সময়ই নাক গলিয়েছেন। নিজেদের পছন্দমতো কিংবা নিজেদের সিদ্ধান্তের বাইরে যাবেন না, এমন কর্মকর্তাদের পদায়ন করেছেন।

একটা সংস্কারের আকাক্সক্ষা নিয়ে সংঘটিত ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থান। একটা ভারসাম্যপূর্ণ শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ব্যাপক সংস্কারের জন্য দেশ এখন প্রস্তুত। নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, বেসামরিক প্রশাসন, নিরাপত্তা বাহিনী ও ব্যাংকিং ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের পরই নির্বাচন হতে পারে। এতে একটু সময় লাগলেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে নিতে হবে।

বাংলাদেশে আজকের পরিস্থিতির প্রধান কারণ আমাদের সংবিধানের ক্ষমতা কাঠামো এককেন্দ্রিক। ক্ষমতা যার হাতে কেন্দ্রীভূত, তার কোনো জবাবদিহির ব্যবস্থা ছিল না। আইনের শাসন যারা চান তারা মনে করেন, জাতীয় সংসদকে এক ব্যক্তির বা গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করে কার্যকর সংসদে পরিণত করতে হবে, যেখানে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে আইন প্রণীত হবে। দলীয় লাঠিয়াল বাহিনী না হয়ে পুলিশ হবে একটি পেশাদার সংস্থা, যারা জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধানকে অগ্রাধিকার দেবে।
বাংলাদেশে সম্প্রতি অর্ধ-শতাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে ঘুষবাণিজ্য, ঋণ জালিয়াতি, অর্থ পাচার, অবৈধ সম্পদ অর্জনসহ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। অভিযুক্তদের মধ্যে সাবেক মন্ত্রী থেকে শুরু করে বড় বড় আমলা যেমন রয়েছেন, তেমনি দেখা যাচ্ছে একাধিক ব্যবসায়ী ও ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর নামও। সদ্য সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানকে নাকি বস্তা বস্তা টাকা ঘুষ দিতে হতো। এ নিয়ে বিস্তারিত খবর প্রকাশিত হয়েছে পত্রপত্রিকায়। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আছে দেশটির অন্যতম বড় ব্যবসায়িক গোষ্ঠী ‘এস আলম গ্রুপ’। গত কয়েক বছরে প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে প্রায় এক লাখ কোটি টাকার মতো ঋণ নিয়েছে, যার একটি বড় অংশই অনিয়ম ও জালিয়াতির মাধ্যমে নেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব অর্থের বেশিরভাগই আবার বিদেশে পাচার করা হয়েছে বলে স্থানীয় গণমাধ্যমের খবরে উঠে আসছে।

প্রায় একই ধরনের অভিযোগ রয়েছে শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ-বিষয়ক উপদেষ্টা ও বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমানের নামে। দু-এক ব্যবসায়ীকে এত ব্যাংকের মালিকানা দেয়া হয়েছে, যা সম্পূর্ণ বেআইনি। জামানত ছাড়াই সীমাহীনভাবে তাদের ঋণ দেয়া হয়েছে। যে টাকা পাচার হয়েছে, তা ফিরিয়ে আনতে হবে। আমাদের দেশে দুর্নীতি ও ঘুষ-বাণিজ্যের অবসান ঘটে গেছে, এমনটা মনে করার সময় এখনও আসেনি। আমলাতন্ত্র, রাজনীতিক ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা যেভাবে অনিয়মে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন, তাতে খুব শিগগিরই এ থেকে নিষ্কৃতি মিলবে কি না, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা আছে। আমরা গোটা সমাজব্যবস্থার একটি পরিবর্তন চাচ্ছি, যেখানে থাকবে না কোনো বৈষম্য। আমরা বারবার হোঁচট খেয়েছি। কাজেই আবার সুযোগ এসেছে বৈষম্যহীন সমাজ তৈরি করার, গোটা সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন আনয়নের। এমন কিছু কাজ করতে হবে, যাতে পরবর্তী রাজনৈতিক সরকারগুলো ইচ্ছা করলেও বড় কোনো পরিবর্তন না আনতে পারে।