বর্মনদের জীবনমানে নানা সংকট

প্রতিনিধি, শেরপুর: ভালো নেই শেরপুর জেলার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বর্মন সম্প্রদায়ের মানুষ। জেলার সীমান্তবর্তী গারো পাহাড় এলাকা ছাড়াও সমতলের বিভিন্ন এলাকায় বসবাস করছে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী বর্মনরা। বিশেষ করে জেলার শ্রীবর্দী উপজেলার রানীশিমুল ইউনিয়নের রানীশিমূল গ্রামের বর্মন পল্লিতে রাজবংশী গোত্রীয় বর্মনদের ৩৩১ পরিবারের প্রায় সহস্রাধিক সদস্য রয়েছে। 

সম্প্রতি ওই গ্রামে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, নানা সম্যসা ও দুর্ভোগে জর্জরিত হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করে আসছেন ওই ‘বর্মন পল্লি’র অধিবাসীরা। বয়স্ক, বিধবা এবং প্রতিবন্ধী ভাতাসহ সমাজিক ও ধর্মীয় নানা ধরনের বৈষম্যের শিকার হয়ে আসছেন তারা। ভাতা প্রদানের ক্ষেত্রে স্থানীয় মেম্বার ও প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছেন তারা। অভিযোগ রয়েছেÑটাকা ছাড়া বয়স্ক-বিধবা-প্রতিবন্ধী কোনো কার্ডই মিলে না তাদের। একটা কার্ডের জন্য জনপ্রতিনিধিদের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়। ঘুরে ঘুরেও অবশেষে টাকা ছাড়া মিলে না কাক্সিক্ষত সেই কার্ড। কথা হয় কার্ড না পাওয়া বিধবা নীরুবালা বর্মন (৭৭), উপমান বর্মন (৮২), দুর্গামনি বর্মন (৬৯), শান্তি বর্মন (৮২), বীজালা বর্মন (৮৪), সৃষ্টি রানী বর্মন (৮২), পবিত্রী রানী বর্মন (৭৪), বজবালা বর্মন (৭১), কিরণ বর্মন (৭৩), শান্তবালা বর্মন (৬৮), নন্দ রানী বর্মন (৭০), বৃদ্ধ দীগেন্দ্র চন্দ্র বর্মন (৯০) ও সুবাষ গোস্বামী (৮৯)’র সঙ্গে।

তারা জানান, ‘আমরা অন্য ধর্মের লোক হওয়ায় আমাদের দিকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় না। আমরা ধর্মীয় বৈষম্যের শিকার হয়ে আসছি। একটা কার্ডের জন্য তাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়। আর ঘুরেও কোনো লাভ হয় না। টাকা ছাড়া তাদের কোনো কার্ড প্রদান করা হয় না। প্রতিটা কার্ডের বিনিময়ে আমাদের কাছ থেকে ঘুষ হিসেবে চাওয়া হয় ছয় থেকে সাত হাজার টাকা।

এছাড়া শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান প্রভৃতি ক্ষেত্রেও পিছিয়ে রয়েছে এ ‘বর্মন পল্লি’র অধিবাসীরা। এলাকার আশেপাশে কোনো প্রাথমিক বা মাধ্যমিক স্কুল নেই। তাদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার জন্য যেতে হয় সে দূরের রানীশিমুল ইউনিয়ন বাজার স্কুলে। অথচ এ ইউনিয়নে শিক্ষার হার ৪৫ ভাগ। স্বাস্থ্যসেবা থেকেও পিছিয়ে তারা। আশেপাশের কোনো ইউনিয়নে চিকিৎসাকেন্দ্র বা উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র না থাকায় চিকিৎসার জন্য ছুটতে হয় শ্রীবরর্দী উপজেলা সদরের ১০০ শয্যাবিশিষ্ট একটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। কিন্তু সেখানেও ডাক্তার ও সরঞ্জামাদির অভাবে শুধু প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে আবারও ছুটতে হয় জেলা সদরের হাসপাতালে।

এদিকে, বর্তমান সরকারের আমলে গৃহহীনদের ঘর প্রদান কার্যক্রম অব্যাহত থাকলেও ব্যতিক্রম দেখা যায় এ ‘বর্মন পল্লি’তে। ধর্মীয়  বৈষম্যতা, অনিয়ম-দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির কারণে অনেক অসহায়-গরিব-দুঃখী গৃহহীন হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে, যা অত্যন্ত কষ্ট ও বেদনাদায়ক।

এ বর্মন পল্লিতে তিনটি মন্দির রয়েছে, রাধা গোবিন্দ, নাগ ও বাসন্তি মন্দির। নিজেদের অর্থায়নে রাধা গোবিন্দ ও বাসন্তি মন্দিরের সংস্কারকাজ সম্পন্ন হলেও, নাগ মন্দিরের রয়েছে বেহাল দশাÑযার চারদিকে ফাঁকা, একটি বেড়াও নেই। অথচ, গীতা শিশু স্কুলে এখানে প্রতিদিন শিক্ষা নেয় প্রায় ২৫-৩০ জন শিক্ষার্থী।

‘বর্মন পল্লির নানা সমস্যার বিষয়ে জাতীয় হিন্দু মহাজোটের রানীশিমুল ইউনিয়ন শাখার সভাপতি গোপীনাথ বর্মন জানান, বর্তমান সরকারের গৃহীত নানা সুন্দর সুন্দর উদ্যোগ ও কার্যক্রম সমাজে পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু আমরা যারা ভিন্ন ধর্মের আছি, তাদের ক্ষেত্রে এর চিত্র ভিন্ন। জনপ্রতিনিধিরা টাকা ছাড়া কোনো বয়স্ক-বিধবা-প্রতিবন্ধী কার্ডই প্রদান করেন না। গৃহহীনদের বাসস্থানেরও কোনো ব্যবস্থা করে দেন না। এর সুষ্ঠু বিচার চাই। আমাদের ন্যায্য অধিকার আমরা ফিরে পেতে চাই।

অন্যদিকে, ‘বর্মন পল্লি’তে সরকারের নানা সুবিধা প্রদানে অনিয়ম-দুর্নীতি প্রসঙ্গে রানীশিমুল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাসুদ রানা জানান, এ ‘বর্মন পল্লি’তে এত অনিয়ম-দুর্নীতি চলছে, তা আমার জানা ছিল না।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০