সাইফুল আলম: পয়লা বৈশাখে মঙ্গল শোভাযাত্রা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মেলা ও রঙ-বেরঙের পোশাক এবং সজ্জায় বর্ণিল হয়ে ওঠে চট্টগ্রাম। কাকডাকা ভোর থেকেই পথে পথে ঢল নামে নগরবাসীর। বিশেষ করে ডিসি হিল, চারুকলা প্রাঙ্গণ, সিআরবি মাঠ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়োজনে মুখর হয়ে ওঠে বন্দরনগরী। এবারও ব্যতিক্রম নয়; প্রাণচাঞ্চল্যে মুখর হয়ে উঠবে এখানকার দৃশ্যপট।
কোথাও কোথাও রং ছিটিয়ে উৎসব পালন করতে দেখা যায় তরুণ-তরুণীদের। প্রায় সব ঘরে চলে বর্ষবরণের আয়োজন। বাংলা নববর্ষে ব্যবসায়ীদের ‘হালখাতা’ রীতি কিছুটা হলেও এদেশের নিজস্ব সংস্কৃতির আমেজ নিয়ে টিকে আছে। খাতায় পুরোনো হিসাব মিটিয়ে নতুন বছরে নবসূচনার জন্য এদিন ব্যবসায়ীরা সংশ্লিষ্টদের দাওয়াত দিয়ে মিষ্টিমুখ করান। সবমিলিয়ে এটি সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে। এক সময় এমনটি ছিল না। তখন নববর্ষ বা পয়লা বৈশাখ ‘আর্তব উৎসব’ তথা ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে পালিত হতো।
চট্টগ্রামে বৈশাখি উৎসবের মূল আকর্ষণ লালদীঘি ময়দানে জব্বারের বলীখেলা ও মেলা। বিগত বছরগুলোর ধারাবাহিকতায় এবারও চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী জব্বারের ১০৮তম বলীখেলা ও বৈশাখি মেলা। আয়োজক কমিটি সূত্রে জানা যায়, বর্ণাঢ্য ও বর্ণিল আয়োজনের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক মোড় থেকে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও জেল রোড থেকে শহীদ মিনার পর্যন্ত বসবে এ বৈশাখি মেলা। লালদীঘি ময়দানের আশপাশের তিন কিলোমিটার স্থানজুড়ে আয়োজিত হয়ে আসা মেলাটি বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের সবচেয়ে বড় বৈশাখি মেলা। মেলা উপলক্ষে দূর-দূরান্ত থেকে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প ব্যবসায়ীরা পণ্য সামগ্রী নিয়ে আসেন। মেলায় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র থেকে বাহারি ও শৌখিন পণ্য পাওয়া যায়। এর পাশাপাশি নাগরদোলা, নৌকাবাইচ, লাঠি খেলা, সার্কাসসহ বিচিত্র অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়। এ মেলায় শত কোটি টাকার অধিক লেনদেন হয়।
১৯৭২ সালে ডিসি হিলে বৈশাখ উদযাপন শুরু হয়। গত এক দশক ধরে নগরের সিআরবি, শিল্পকলা একাডেমি, শহীদ মিনার, পতেঙ্গা সৈকতসহ অনেক এলাকায় বৈশাখের উৎসব যোগ হয়। গত কয়েক বছর ধরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিতভাবে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করা হয়। এতে প্রায় অর্ধ-লাখ মানুষ অংশ নেন। সম্মিলিত পয়লা বৈশাখ উদযাপন পরিষদের আহ্বায়ক আহমেদ ইকবাল হায়দার বলেন, ‘প্রতিবছরের মতো এবারও চট্টগ্রাম ডিসি হিলে বাংলা বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ উপলক্ষে দুদিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়েছে। এজন্য পরিষদের পক্ষ থেকে ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।’
বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় অনেক ক্ষুদ্র জাতিসত্তা রয়েছে। তাদেরও নিজ নিজ বর্ষবরণ উৎসব রয়েছে। যেমন ত্রিপুরাদের বৈসুখ। মারমাদের সাংগ্রাই। চাকমাদের বিজু উৎসব। বর্তমানে কয়েকটি নৃ-গোষ্ঠী একত্রে ‘বৈসাবি’ উৎসব পালন করে। এ উৎসবের নানা দিক রয়েছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে মার্মাদের পানি উৎসব। চট্টগ্রাম সর্বজনীন বৈসাবি উদযাপন কমিটির উদ্যোগে গত শুক্রবার দিনভর নানা কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। নগরীর ডিসি হিলে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বৈসাবি উৎসবে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা জাতির একক ও দলীয় গান পরিবেশন করা হয়। এছাড়া তঞ্চঙ্গ্যা, আসাম ও মনিপুরী নৃত্য ও বম বাঁশ নৃত্যও পরিবেশিত হয়। ডিসি হিল প্রাঙ্গণে সর্বজনীন বৈসাবি উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক ম্রাপাইংখয় মারমা বলেন, ‘এ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পাহাড়ি জনগণের সঙ্গে সমতলের জনগণের ঐক্য, সংহতি ও সম্প্রীতির নতুন দিগন্ত উম্মোচন করবে। আমাদের পাহাড়িদের নিজেদের সংস্কৃতিকে রক্ষার জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।’
পয়লা বৈশাখ ঘিরে চট্টগ্রামে কয়েক বছর ধরে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পাচ্ছে। উৎসব মানে তো নতুন কাপড়। সবাইকে নিয়ে নানা রকম উপাদেয় খাবার খাওয়া, ঘুরে বেড়ানো। উৎসব ঘিরে কেনাকাটায় ব্যস্ত অনেক নগরবাসী। নানান পসরা নিয়ে দোকানিরাও ব্যস্ত সময় পার করছে। সব মিলে জমে উঠেছে চট্টগ্রামের বাজারগুলো। গতকাল চট্টগ্রামের স্যানমার ওশান সিটি, আমিন সেন্টার, ইউনুস টাওয়ার, আফমি প্লাজাসহ অধিকাংশ বিপণিবিতানের দেশি দশ, আড়ং, শৈল্পিক, বিবিয়ানা, মিয়া-বিবি, পিনন, সালসাবিল, রওশন’স বুটিকস ও কৃষ্টি বুটিকসে ক্রেতার উপস্থিতি দেখা গিয়েছে।
বৈশাখের রকমারি পোশাক নিয়ে চট্টগ্রামের ফ্যাশন হাউজ কৃষ্টির প্রধান ডিজাইনার ও স্বত্বাধিকারি নূজহাত কৃষ্টি বলেন, ‘বৈশাখ আমাদের ঐতিহ্যের উৎসব। এখানে বাইরের মোটিফ ব্যবহারের সুযোগ নেই। তবে পোশাকে ঢাকঢোল, পাখা, একতারা থেকে বের হয়ে একটু ভিন্ন ঢঙের ও রঙের সম্মিলন ঘটিয়েছি। আমাদের এখানে রঙের ক্ষেত্রে প্রচলিত লাল-সাদার বাইরে কয়েকটি রঙের মিশ্রণ পাওয়া যাবে।’ তাছাড়া তাপমাত্রাকে প্রাধান্য দিচ্ছেন তারা। এ প্রসঙ্গে দেশীদশের দেশাল শাখা প্রধান খালেক সোহেল বলেন, এবারের বৈশাখে কেনাকাটায় ভালো সাড়া পাচ্ছি। গতকালও প্রায় দুই লাখ টাকার কাপড় বিক্রি করেছি।
চট্টগ্রাম শহরের খুচরা ও পাইকারি বাজারে গিয়ে দেখা যায়, ইলিশ মাছের সরবরাহ কম। নগরীর কাজীর দেউরি বাজারে দেখা যায়, এক কেজি ওজনের ইলিশের দাম ১৫০০ টাকা। ৫০০ গ্রাম ওজনের কেজি ৯০০ টাকা। চকবাজারে এক কেজি ওজনের ইলিশের দাম ১২০০ টাকা। ৫০০ গ্রামেরটি ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকার মধ্যে ওঠানামা করছে। চকবাজারের মাছ বিক্রেতা আলী আহমদ বলেন, ইলিশের দাম বাড়ছে। অনেকে মাছ মজুদ করছে। চট্টগ্রামের সদরঘাটের পাইকারি আড়ত ফিশারিবাজারের একাধিক আড়তদার জানান, জাটকা রক্ষা অভিযান ও মা-মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞার কারণে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে কম। পাইকারি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের সরবরাহ ১০ শতাংশে নেমে এসেছে।
নববর্ষ ঘিরে সবচেয়ে বেশি লেনদেন হত চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে। হালখাতাকে কেন্দ্র করে বছরের শেষ দিন লেনদেনের হিসাব চূড়ান্ত করতেন ব্যবসায়ীরা। নববর্ষের দিন দেশের নানা জায়গা থেকে ব্যবসায়ীরা বকেয়া টাকা সঙ্গে করে নিয়ে আসতেন। নেওয়ার সময় পণ্য নিয়ে যেতেন। এখন নগদ টাকা দেওয়ার চল নেই। অনলাইন ব্যাংকেই পরিশোধ হয়ে যায় বকেয়া টাকা। তবু পয়লা বৈশাখ ঘিরে কিছুটা হলেও লেনদেন বাড়ে বলে জানালেন ব্যবসায়ীরা। খাতুনগঞ্জের অন্যতম পুরোনো প্রতিষ্ঠান সাহেদ ব্রাদার্সের স্বত্বাধিকারী সাহেদ চৌধুরী বলেন, ‘শত বছরের ঐতিহ্য ধারণ করে আছে হালখাতা। এ ঐতিহ্যে ছেদ পড়লেও এখনো পয়লা বৈশাখে হালখাতা ঘিরে লেনদেন বাড়ে। হিসাব-নিকাশের জন্য গত দুই সপ্তাহ লেনদেন কিছুটা কম ছিল। এখন নিয়ম রক্ষার খাতিরে পয়লা বৈশাখের দিন মিষ্টি বিতরণ করব। ব্যবসায়ীরাও আসবেন।’
চট্টগ্রাম
Add Comment