বর্ষা শুরুর আগেই জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রস্তুতি দরকার

রবিউল আওয়াল পারভেজ : গত ৭৬ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে স্থায়ী আর তীব্র তাপপ্রবাহের মধ্য দিয়ে গেল বাংলাদেশ। টানা ৩৭ দিন দেশের কোনো না কোনো অঞ্চল দিয়ে তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে। কিছু কিছু অঞ্চলে কিছুটা স্বস্তির আভাস মিললেও এখনও দেশের বিভিন্ন স্থানে তাপপ্রবাহ চলমান। জুন মাস থেকে শুরু হবে বর্ষার মৌসুম।? সাউথ এশিয়ান ক্লাইমেট আউটলুক ফোরামের ২৮তম অধিবেশনে দক্ষিণ এশিয়ার আবহাওয়াবিদরা বলেছেন এবারের বর্ষা মৌসুমে স্বাভাবিকের তুলনায় বৃষ্টিপাত বেশি হবে। এতে দেশবাসী তীব্র গরমের হাত থেকে রক্ষা পাবে। মিলবে বেশ খানিকটা স্বস্তি। তবে রাজধানী রাজধানীবাসীদের জন্য অপেক্ষা করছে আরেক সংকট। প্রতিবছর ঢাকায় বর্ষাকালে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। প্রায় দুই কোটি মানুষের এই শহরে নিত্যদিন যানজট লেগেই থাকে। উপরন্তু বৃষ্টি হলে জলাবদ্ধতার হেতু যানজটের শহর ঢাকায় চলাচল প্রায় স্থবির হয়ে পড়ে।

ঢাকাবাসীর জন্য এ যেন উভয় সংকট। গ্রীষ্মকালে সহ্য করতে হয় অসহ্য গরম, দগ্ধ হতে হয় তীব্র তাপে। আর এদিকে বর্ষাকালে বৃষ্টি হলে তীব্র গরম থেকে রক্ষা পেলেও যানজটের শহর ঢাকায় জলাবদ্ধতার কারণে পড়তে হয় মহাবিপদে। এ যেন ডাঙ্গায় বাঘ, জলে কুমির।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) ‘নগর পরিস্থিতি’ শীর্ষক ২০১৫-এর বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যস্ত সময়ে ঢাকা নগরীতে গাড়ির গড় গতিবেগ ২০০৪ সালের ঘণ্টাপ্রতি ২১ দশমিক ২ কিলোমিটার থেকে নেমে ২০১৫ সালে ৬ দশমিক ৮ কিলোমিটারে এসে পৌঁছেছে; যা হাঁটার গতির থেকে একটু বেশি। সম্প্রতি বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) গবেষণায় দেখা যায়, যানজটের কারণে ব্যস্ত সময়ে রাজধানীতে গণপরিবহনের গতি এখন ঘণ্টায় গড়ে ৫ কিলোমিটারে নেমে এসেছে। এটা হাঁটার গতির সমান। কাজেই বোঝায় যাচ্ছে, বৃষ্টিহীন সময়ে ঢাকার পরিস্থিতি এমন হলে, বর্ষাকালে পরিস্থিতি আরও কতটা ভয়াবহ হয়ে ওঠে।

 অপরদিকে বর্ষাকালে জলাবদ্ধতা ঢাকায় পানিতে বৈদ্যুতিক তার ছিঁড়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মানুষ মারা যায়। ২০২৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বর বৃষ্টির মধ্যে ঢাকার মিরপুরে বিদ্যুৎস্পষ্ট হয়ে একই পরিবারের তিনজনসহ মোট চারজনের মৃত্যু হয়েছে। সেই ভয়াল দৃশ্যও আমরা দেখেছি।

মোটাদাগে বর্ষাকালে জলাবদ্ধতার কারণগুলো? হলো নগরায়ণের ফলে ঢাকায় অনাবৃত মাটি খুব কম। অধিকাংশ জায়গা কংক্রিটের রাস্তা ফলে মাটি পানি শোষণ করতে পারছে না। এছাড়া ঢাকার বহুসংখ্যক খাল হয় বেদখল হয়েছে অথবা ময়লা-আবর্জনায় ভরাট হয়ে পানি ধারণের অনুপোযোগী হয়ে উঠেছে। ৫২-৫৭টি খালের মধ্যে এখন ২৬টি খাল অবশিষ্ট রয়েছে। ২০২০ সালে জলাবদ্ধতা নিরসনের অংশ হিসেবে ঢাকা ওয়াসা ২৬টি খাল  দুটি সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করে। তবে সেগুলোর এখনও বেহাল দশা। রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ সম্প্রতি এক পত্রিকাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘ঢাকার খালগুলো শুধু হাতবদল হয়েছে। প্রকৃত অর্থে কোনো কাজই হয়নি। মালিকানা পাওয়ার পর প্রথম কাজ ছিল সীমানা নির্ধারণ করা। ডিএসসিসি কিংবা ডিএনসিসি পরিপূর্ণভাবে একটি খালের সীমানা নির্ধারণ করতে পারেনি। দুই সিটি করপোরেশন এখনও এমন একটি আদর্শ খাল তৈরি করতে পারেনি, যেখানে দখল-দূষণের কোনো অস্তিত্ব নেই। বিপরীতে খাল পরিষ্কার ও বিশেষ অভিযানের নামে কোটি কোটি টাকা খরচ হয়েছে।’

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানারসের (বিআইপি) এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, গত নয় বছরে ঢাকার মহানগর ও এর আশপাশে কমপক্ষে ৩ হাজার ৪৮৩ একর জলাশয় এবং নিম্নভূমি ভরাট হয়েছে এবং ২০১০ সালে প্রণীত বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) নিয়মনীতি উপেক্ষা করে ঢাকার ৩৬% জলাশয় ও নিম্নাঞ্চল ভরাট করা হয়েছে; যা জলাবদ্ধতা সৃষ্টির অন্যতম একটি কারণ।

ঢাকার পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাও বেশ নাজুক। নর্দমা-ড্রেনে কঠিন ময়লা আবর্জনা জমে থাকার ফলে ড্রেনগুলো অনেকটা আবদ্ধ হয়ে থাকে। পানি প্রবাহে বিঘ্ন ঘটে। বৃষ্টি হলেই সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা।

হতাশার কথা, ঢাকার আশপাশে নদীগুলো বিভিন্ন অসাধু চক্র ভরাট করে ফেলছে। ফলে ক্রমে পানি প্রবাহের পথ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

এদিকে বর্ষাকালের ঠিক আগ মুহূর্তে শহর জুড়ে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ চলছে। এ অবস্থায় বৃষ্টি হলে নিশ্চিতভাবেই জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হবে। এছাড়া রাজধানীজুড়ে বিভিন্ন ভাঙাচোরা রাস্তা রয়েছে। একটু বৃষ্টি হলেই সেই সব ছোটখাটো গর্তে পানি জমে ফলে জনসাধারণকে চলাচলে বেশ? সমস্যায় পড়তে হয়।

এমনিতেই রাজধানী ঢাকা নানান সমস্যার জর্জরিত। তার ওপর যদি জলাবদ্ধতা সমস্যা দেখা দেয় তাহলে সেটাকে মরার উপর খাঁড়ার ঘা বললে কমই বলা হয়।

আসন্ন বর্ষাকালের পূর্বেই জলবদ্ধতা সংকট পুরোপুরি নিরসন করা সম্ভব নয়। তবে পরিকল্পিতভাবে বেশ কিছু ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে এর সংকট অনেকটা নিয়ন্ত্রণ আনা সম্ভব। বর্ষার পূর্বেই যেসব? ড্রেন-নর্দমায় ময়লা-আবর্জনা স্তূপ জমেছে সেগুলোকে পরিষ্কার করতে হবে। এই সময়ের মধ্যে যতটা সম্ভব শহরজুড়ে খালগুলো সংস্কার কাজ এগিয়ে নিতে হবে। যাতে বর্ষার মৌসুমে সবগুলো না হোক অন্তত কয়েকটি খাল কাজে আসে। বর্তমানে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কাজ চলছে। বর্ষাকালে আসার পূর্বেই সেই সব সংস্কার কাজ শেষ করতে হবে। ভূমিদস্যুদের কবল থেকে নদীগুলোকে রক্ষা করতে হবে। এছাড়া রাজধানীবাসীদের সচেতন হতে হবে। নর্দমা বা খালে ময়লা-আবর্জনা না ফেলে নির্ধারিত স্থানে তা ফেলতে হবে।

আমরা আশা করি, জলাবদ্ধতার সংকট মোকাবিলায় ওয়াসা ও দুই সিটি করপোরেশন আসন্ন বর্ষাকালের পূর্বে পরিকল্পনামাফিক যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। পাশাপাশি বিশেষজ্ঞদের নিয়ে পুরোপুরি জলাবদ্ধতা সমস্যা নিরসনে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করবে এবং তা বাস্তবায়ন করবে।

শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০