Print Date & Time : 29 June 2025 Sunday 6:42 pm

বহির্নোঙরে জাহাজজট লোকসানে ব্যবসায়ীরা

সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: চট্টগ্রাম বন্দরে অন্যান্য মাসের তুলনায় দৈনিক গড়ে পাঁচ ঘণ্টা কাজ কম হয়েছে রোজার মাসে। সাম্প্রতিক সময়ে অতিবর্ষণ ও দুর্যোগকালীন আবহাওয়ায় কয়েকদিন পরিচালন কার্যক্রম কিছুটা ব্যাহত হয়। এছাড়া ঈদের ছুটি ও শ্রমিক সংকটে জাহাজজট দেখা দেয়। পাশাপাশি বন্দরে কনটেইনারের সংখ্যাও এখন ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি। ফলে বন্দর ব্যবহারকারীদের ভোগান্তি ও আর্থিক লোকসান গুনতে হচ্ছে। তবে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো সুবিধা থাকলে এ ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হতো না বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ও বন্দর ব্যবহারকারী আমদানিকারকদের মতে, পণ্যবাহী বড় জাহাজ বন্দরের জেটি থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে সাগরে নোঙর করে রাখা হয়। ওই এলাকা বহির্নোঙর নামে পরিচিত। বড় জাহাজে করে আনা পণ্য সেখানে ক্রেনের সাহায্যে লাইটার জাহাজে স্থানান্তর করা হয়। কিন্তু আমদানি হওয়া পণ্য সময়মতো বন্দরের জলসীমায় পৌঁছালেও তা খালাসে সময়ক্ষেপণ হয়। বন্দরে পণ্য খালাসের জন্য প্রতিদিন গড়ে ২০টি জাহাজ বহির্নোঙরে অপেক্ষা করছে। এ বহির্নোঙরে বর্তমানে সব ধরনের জাহাজ আছে ১৩৩টি। এর বিপরীতে কনটেইনার ওঠানামার কার্যক্রম চালু রয়েছে ১২টি জেটিতে। পণ্য খালাসের জন্য জেটি খালি না পাওয়ায় বন্দরের বহির্নোঙরে এখন তীব্র জাহাজজট দেখা দিয়েছে।
ট্রাফিক বিভাগের পরিসংখ্যান অনুসারে, গত ২২ জুনে বন্দরের খালাসযোগ্য ১১৬টি জাহাজ ছিল। এর মধ্যে খালাস হয় ৬৫টি জাহাজ। আর ৫১টি জাহাজ খালাসের জন্য অপেক্ষায় ছিল। এছাড়া জেটিতে ভেড়ার জন্য আরও ৩৯টি জাহাজ অপেক্ষমাণ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে কনটেইনারবোঝাই জাহাজ, গম, চাল, চিনি, অশোধিত জ্বালানি, সিমেন্ট শিল্পের কাঁচামাল এবং অন্য সাধারণ পণ্য নিয়ে জাহাজ রয়েছে। আর জেটিতে ভিড়তে একেকটি জাহাজের এখন ১০ দিন পর্যন্তও সময় লেগে যায়। এছাড়া বন্দরের অভ্যন্তরে কনটেইনারের ধারণক্ষমতা ২৬ হাজার ৮৫৭টি। এর বিপরীতে এখানে কনটেইনার জমেছে ৩৭ হাজার ৩১৬টি। অর্থাৎ ধারণক্ষমতার চেয়েও অতিরিক্ত প্রায় সাড়ে ১০ হাজার কনটেইনার এখন বন্দরের অভ্যন্তরে আটকে রয়েছে।
বিএসআরএম গ্রæপ সূত্রে জানা যায়, রড, চ্যানেল, বার ও অ্যাঙ্গেল উৎপাদনের জন্য গত বছর তারা ২৪টি বাল্ক জাহাজে কাঁচামাল আমদানি করে। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ে একটি জাহাজও বন্দরের বাড়তি সুযোগ পায়নি। এসব জাহাজকে সর্বোচ্চ ৭০ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। এ অতিরিক্ত অপেক্ষার জন্য গ্রæপটিকে প্রায় ৬০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ হিসেবে গুনতে হয়, যা আগের বছরে ছিল ১০ কোটি টাকা। শুধু এ গ্রæপ নয়, গত দেড় বছরে প্রায় চার হাজার জাহাজকে কম-বেশি অতিরিক্ত সময় অপেক্ষার জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে হয়। এ ক্ষতিপূরণের টাকা পুরোটাই বিদেশি কোম্পানিগুলো নিয়ে যায়, যা নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বৈদেশিক মুদ্রা খাতে। মেরিন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙ্গর এলাকা আরও সম্প্রসারণ করা প্রয়োজন। কারণ অতীতের তুলনায় অধিক সংখ্যক জাহাজ আসে চট্টগ্রামে। কিন্তু সে তুলনায় বার্থিং সুবিধা বৃদ্ধি না পাওয়ায় জাহাজকে বহির্নোঙরে অপেক্ষমাণ থাকতে হয়। আবার সাধারণ পণ্যবাহী অনেক জাহাজ পণ্য লাইটারিং করে বহির্নোঙর থেকে ফিরে যায়। তাই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে বহির্নোঙর এলাকা সম্প্রসারণ করা, কারণ যতদিন বে-টার্মিনাল এবং অন্যান্য টার্মিনাল চালু হবে না, ততদিন এই সংকট থেকেই যাবে। তাই প্রয়োজন বহির্নোঙর এলাকা বাড়ানো।
সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা জানান, জাহাজজটের কারণে দেরিতে আমদানি করা পণ্য পাওয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তৈরি পোশাক খাত। পোশাক খাতে বাংলাদেশের প্রতিযোগী ভিয়েতনাম, চীন, শ্রীলঙ্কা, ভারত কিংবা কম্বোডিয়ার মতো প্রতিযোগী দেশের বন্দরে জাহাজজটের সমস্যা নেই। কাঁচামাল আমদানি ও রফতানিতে তাদের তুলনায় দেশীয় উদ্যোক্তারা এখন গড়ে এক থেকে দুই সপ্তাহ পিছিয়ে পড়েছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিকেএমইএ’র পরিচালক শওকত ওসমান শেয়ার বিজকে বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে প্রতি মাসে গড়ে দুই লাখ কনটেইনারে পণ্য আমদানি হয়। সাধারণত একটি জাহাজে গড়ে এক হাজার কনটেইনার ভর্তি আমদানি পণ্য থাকে। এসব কনটেইনারে আমদানি করা পণ্যের বড় অংশই বিভিন্ন শিল্পসহ পোশাকশিল্পের কাঁচামাল। কিন্তু জাহাজজটের কারণে আমদানি পণ্য দেরিতে হাতে পাওয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় তৈরি পোশাক খাত। আর বন্দরে দ্রæত সক্ষমতা না বাড়ালে পোশাক খাতের ব্যবসা পরিচালনা কঠিন হয়ে যাবে, কারণ পোশাক খাতে আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলোর এ সমস্যা নেই।
বন্দর ব্যবহারকারী ফোরাম ও চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর দেশের অর্থনীতির প্রাণ। দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে এ বন্দরের জেটি নির্মাণ, টার্মিনাল নির্মাণ প্রভৃতি অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বন্দর কর্তৃপক্ষের পরিচালক (ট্রাফিক) গোলাম সরোয়ার শেয়ার বিজকে বলেন, প্রতিবছর চট্টগ্রাম বন্দরের জাহাজ ও কনটেইনার হ্যান্ডলিং বৃদ্ধি পাচ্ছে, কিন্তু জেটির সংখ্যা তো বাড়েনি। বিদ্যামান সক্ষমতা দিয়ে আমরা প্রতিনিয়ত অতিরিক্ত সেবা দিয়ে যাচ্ছি। এতে আমাদের কনটেইনার ও জাহাজ হ্যান্ডলিং বাড়ছে। তিনি বলেন, বর্তমানে জেটিতে ভেড়ার জন্য ২০টি জাহাজ অপেক্ষায় আছে, যা আগের বছরে এ সময়ে আরও বেশি ছিল। গত সপ্তাহে বিশেষ করে বন্দরের জাহাজ হ্যান্ডলিং ও কনটেইনার ডেলিভারি কার্যক্রম অনেকটাই স্থবির ছিল, কারণ জাহাজ ও পণ্য খালাস প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্টরা অংশগ্রহণ করেননি। তবে এখন পুরোদমেই কাজ চলছে। খুব দ্রæতই বহির্নোঙরে জাহাজজটের নিরসন হবে।
উল্লেখ্য, দেশে বাণিজ্যিক কার্যক্রমে কনটেইনার পরিবহনের ৯৮ শতাংশই ঘটে সমুদ্রপথে।