এস এম রুবেল, কক্সবাজার: কক্সবাজারে বাণিজ্যিক নদী বাঁকখালী দখল করে অবৈধ স্থাপনা গড়ে তুলেছিল প্রভাবশালী কয়েকটি গ্রুপ। তাদের সেসব স্থাপনা উচ্ছেদে অভিযান চালিয়েছে প্রশাসন।
গতকাল মঙ্গলবার সকাল ১০টা থেকে দিনব্যাপী এ উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করেন কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে পরিবেশ অধিদপ্তর, বনবিভাগ, বিআইডব্লিউটিএসহ বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তারা।
অভিযানে বাঁকখালীর তীরবর্তী সীমানা পিলার দিয়ে দখল করা শতাধিক পিলার ভেঙে দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে ২ শতাধিক ভবন ও ঘর ভেঙে দিয়েছে প্রশাসন।
অপরদিকে উচ্ছেদ অভিযান চলার সময় দুপুরে ২টার দিকে সংবাদ সংগ্রহের দায়িত্বে থাকা সাংবাদিকদের ওপর হামলা চালিয়েছে আবদুল খালেক নামের এক দখলদার। এতে কয়েকজন সাংবাদিক আহত হয়েছেন। ওই দখলদার শাপলাপুর ইউপি চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রয়েছেন।
সাংবাদিকরা জানিয়েছেন, হঠাৎ হাতে লাঠি নিয়ে আবদুল খালেকসহ তার সঙ্গে থাকা যুবকরা গালি-গালাজ করতে করতে সাংবাদিকদের ওপর হামলা চালায়। এ সময় ডিবিসি নিউজ ও বিডিনিউজের প্রতিনিধি শংকর বড়ুয়া রুমি, আজকের পত্রিকার প্রতিনিধি মাইন উদ্দিন শাহেদ, ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের প্রতিনিধি তৌফিকুল ইসলাম লিপুসহ কয়েকজন ক্যামেরা পারসনকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করা হয়।
পরিস্থিতি উত্তপ্ত দেখে উপস্থিত পুলিশসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন।
অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. আবু সুফিয়ান জানিয়েছেন, উচ্ছেদ অভিযান চলবে। এখানে অনেকভাবে উচ্ছেদ বন্ধ করার চেষ্টা চলছে। অনেকে আইনজীবী এনে উচ্ছেদে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছেন। কিন্তু হাইকোর্টের আদেশে এ উচ্ছেদ চলছে। নদীর সব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ না হওয়া পর্যন্ত অভিযান চলবে। সাংবাদিকদের ওপর হামলাকারী আবদুল খালেকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার কথাও বলেছেন তিনি।
কক্সবাজার শহরের প্রাণ হিসেবে পরিচিত বাঁকখালীর তীরে দখলের মহোৎসব চলছে গত ৫ বছর ধরে। নদীর তীরে ৬০০ হেক্টর প্যারাবন নিধন করে একে একে চলছে স্থাপনা নির্মাণের কাজ। শুধু ২ মাসের ব্যবধানে নদী তীরের শত হেক্টর জমি দখলের পর চলছে স্থাপনা নির্মাণ। এ দখলে জড়িত রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, আইনজীবী থেকে শুরু করে খোদ পৌরসভা কর্তৃপক্ষও। কয়েক মাস আগেও যেখানে ছিল ম্যানগ্রোভ বা প্যারাবন, পাখির কিচিরমিচির; সেখানে এখন স্থাপনার পর স্থাপনা।
খুরুশকুলের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের জন্য কস্তুরাঘাট পয়েন্টে বাঁকখালীর ওপর নির্মাণ করা হচ্ছে একটি সেতু। এটি নির্মাণ করছে স্থানীয় সরকার অধিদপ্তর (এলজিইডি)। এ সেতুর পাশাপাশি সংযোগ সড়ক তৈরি হওয়ায় সড়কের দুই পাশে প্যারাবন ধ্বংস করে নদী দখলের মহোৎসবে মেতে উঠেছে প্রভাবশালী চক্র।
যদিও এখানে একটি নদীবন্দর নির্মাণের জন্য সরকারের প্রজ্ঞাপন রয়েছে। এর জন্য এ জমি বিআইডব্লিউটিএকে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য হাইকোর্টের রায় রয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করার কথা জানিয়েছেন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট।
পরিবেশ বিষয়ক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এনভায়রনমেন্ট পিপলের প্রধান নির্বাহী রাশেদুল মজিদ বলেন, দেরিতে হলেও বাঁকখালী দখল উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু করায় প্রশাসন সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। তবে অভিযানে পুরো জায়গা উদ্ধার করে নদীকে ফিরিয়ে দিতে হবে। অন্যথায় দখলদারচক্র সুযোগ নেবে এবং অভিযান প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
কক্সবাজার শহরের কস্তুরাঘাটের বদরমোকাম থেকে পেশকারপাড়া পর্যন্ত ৫টি দাগে নদী, খাল ও বালুচর শ্রেণির ১৪৬ একর বাঁকখালী নদীর সরকারি জমি গত দুই বছরে প্রকাশ্যে দখল করা হয়েছে। এসব জমির ১০০ একর প্যারাবন, জীববৈচিত্র্য ও পাখির আবাসস্থল ধ্বংস করা হয়েছে।
কক্সবাজার শহরের প্রধান নদী বাঁকখালী দিয়ে আশির দশকের যাত্রীবাহী জাহাজ চলাচল করত চট্টগ্রাম পর্যন্ত। নদীর কস্তুরাঘাট থেকে জাহাজ চলত টেকনাফ, মহেশখালী ও কুতুবদিয়া উপজেলায়ও। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে দখল, দূষণ ও নদীসংলগ্ন প্যারাবন উজাড়ের মাধ্যমে এ নদীকে হত্যা করা হয়েছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় বাসিন্দরা।