রোহান রাজিব : নামে-বেনামে ঋণ ও নানা অনিয়মে ডুবতে বসছে বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক। ডুবতে বসা ব্যাংকটিকে সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সর্বশেষ গত বছরের আর্থিক প্রতিবেদন ভালো দেখাতে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি ডেফারেল সুবিধা দেয়া হয় ব্যাংকটিকে। সুবিধা পেয়েও আর্থিক অবস্থার উন্নতি দেখাতে পারেনি। বরং গত বছর রেকর্ড পরিমাণ লোকসান গুনে বেসরকারি খাতের এ ব্যাংকটি। ফলে ২০২১ সালের মতো গত বছরের জন্যও শেয়ারধারীদের কোনো লভ্যাংশ না দেয়ার সুপারিশ করেছে ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ।
জানা যায়, ন্যাশনাল ব্যাংকের ঋণ ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা না থাকার কারণে গত বছর বিপুল পরিমাণ ঋণ খেলাপি হয়েছে। যার কারণেই প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে। তাই বিপুল পরিমাণ প্রভিশন ঘাটতির বিপরীতে ডেফারেল সুবিধা নিতে হয়েছে।
নিয়ম অনুযায়ী, ঋণের মানভেদে শূন্য দশমিক ২৫ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত প্রভিশন সংরক্ষণের বিধান রয়েছে। যেসব ব্যাংক তা রাখতে পারে না, তাদের ব্যাংকের মূলধন থেকে সেই ঘাটতি সমন্বয় করা হয়। ফলে ব্যাংকের মূলধন কমে যায়। পাশাপাশি যেসব ব্যাংক পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত তারা ঘাটতি রেখে শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দিতে পারে না। এই দুই সমস্যা সমাধানে ডেফারেল নামক অস্ত্র ব্যবহার করছে ব্যাংক। এতে কাগজে কলমে সাময়িক সমাধান হলেও দীর্ঘমেয়াদে হুমকির সম্মুখীন হবে এ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পরিদর্শন প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত বছর শেষে ন্যাশনাল ব্যাংক তাদের শ্রেণিকৃত ঋণ ও অগ্রিম দেখিয়েছে ৬ হাজার ৬৫৩ কোটি ৮৫ লাখ টাকা, যা মোট ঋণ ও অগ্রিমের ১৫ দশমিক ৮১ শতাংশ। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন দল নতুন করে ব্যাংকটির ৪ হাজার ১৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা শ্রেণিকৃত ঋণ ও অগ্রিম হিসেবে পেয়েছে। ফলে গত বছর শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়ে ১০ হাজার ৬৭০ কোটি ৩৫৬ লাখ টাকা দাঁড়িয়েছে। বিপুল পরিমাণ খেলাপি বাড়ার ফলে গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকটির ১২ হাজার ২৫২ কোটি টাকা প্রভিশন ঘাটতি হয়। তবে ব্যাংক ১ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা সংরক্ষণ করার ফলে তা কমে ১০ হাজার ৮১৬ কোটি ৯৭ লাখ টাকায় দাঁড়ায়। এ পরিমাণ প্রভিশন ঘাটতির কারণে আগামী ২০২৩ সালের আর্থিক বিবরণীর আগ পর্যন্ত ১০ হাজার ৮৬৯ কোটি টাকার ডেফারেল সুবিধা দেয় কেন্দ্রীয়। এসব সুবিধা দিয়ে কৃত্রিমভাবে ভালো দেখানোর সুযোগ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে এমন সুবিধা পেয়েও ব্যাংকটি লোকসানে পড়েছে।
ডেফারেল সুবিধা নেয়ার পরও ব্যাংকটির অবস্থা খারাপ কেন হলো, এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে ন্যাশনাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মেহমুদ হোসেনকে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ করা হলে তিনি তা সিন করলেও কোনো উত্তর দেননি। পরে ব্যাংকটির সিএফও (প্রধান অর্থ কর্মকর্তা) কৃষ্ণ কমল ঘোষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি।
ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণ না করে ডেফারেল সুবিধা নেয়ার মাধ্যমে মূলধন ঘাটতি থেকে সাময়িক মুক্তি পেলেও দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকির মুখে পড়তে যাচ্ছে ব্যাংকটি। প্রভিশন সংরক্ষণে গত বছর ন্যাশনাল ব্যাংকে ৬ হাজার ৪৩৪ কোটি টাকার বিপরীতে ১০ বছর পর্যন্ত অতিরিক্ত সময় (ডেফারেল) দেয়া হয়। তবে এবার এক বছরের জন্য দেয়া হয়।
এ ধরনের সুবিধার ফলে ব্যাংকটির প্রকৃত আর্থিক চিত্র আড়াল করা হচ্ছে। আর আমানতকারীদের আমানত ঝুঁকিতে পড়ে যাচ্ছে বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। তারা বলেন, বিষয়টা আমানতকারীদের জন্য বড় ঝুঁকি। সাধারণ আমানতকারীরা যদি না জানে তারা যে ব্যাংকে টাকা রাখছে তার ভিত্তি দুর্বল, তাহলে তাদের প্রতারিত হওয়ার সুযোগ থাকে।
জানা যায়, গত বছর ব্যাংকটি ৩ হাজার ২৬০ কোটি টাকা লোকসান হয়। মূলত ঋণ থেকে ইন্টারেস্ট ইনকাম না হাওয়া। অন্যদিকে ঋণের টাকাও আদায় হয়নি। আর ব্যাংকটির এলসি বাণিজ্য তেমন না থাকায় কমিশন ইনকাম হয়নি। এছাড়া ব্যাংকটি ২০২২ সালে ২ হাজার ৩৪৭ কোটি টাকার সুদ মওকুফ করেছে। এসব সুদ গত বছরগুলোয় ব্যাংকটি তাদের আয়ের হিসেবে দেখিয়েছিল। আবার মুনাফা থেকে সরকারকে করও পরিশোধ করেছে। মুনাফাও বিতরণ করেছিল। এখন সুদ মওকুফ করায় ব্যাংকটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অন্য হিসাব থেকে এই অর্থ সমন্বয় করতে হচ্ছে। ফলে বড় অঙ্কের লোকসানে পড়েছে।
ব্যাংকটির ২০২২ সালের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুমোদনের পর প্রকাশিত তথ্যে দেখা গেছে, ২০২২ সালে ন্যাশনাল ব্যাংক শেয়ারপ্রতি লোকসান দিয়েছে ১০ টাকা ১৩ পয়সা। ৩ হাজার ২১৯ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধনের ব্যাংকটির শেয়ার সংখ্যা ৩২১ কোটি ৯৭ লাখ ৩৯ হাজার ৫৭০টি। এ হিসাবে লোকসান হয়েছে ৩ হাজার ২৬০ কোটি টাকা। ২০২১ সালে ব্যাংকটি মুনাফা করেছিল ৩৮ কোটি টাকা। একসময় সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনকারী এ বেসরকারি ব্যাংক ২০১৭ সালে নিট মুনাফা করেছিল ৪৬৯ কোটি টাকা। ২০১৮ ও ২০১৯ সালেও ৪০০ কোটি টাকার বেশি মুনাফা করেছিল ব্যাংকটি। ২০২০ সালে মুনাফা কমে হয় ৩৪৮ কোটি টাকা।
ব্যাংকটির বর্তমান ঋণ, আমানত ও খেলাপি ঋণের চিত্র ২০২১ সালে ন্যাশনাল ব্যাংকের আমানত ছিল ৪৭ হাজার ৩১০ কোটি টাকা ও ঋণ ৪৪ হাজার ৫২৮ কোটি টাকা। তবে ২০২২ সালে আমানত ও ঋণ দুটিই কমে গেছে। ২০২২ সাল শেষে আমানত কমে হয়েছে ৪১ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা ও ঋণ কমে হয়েছে ৪২ হাজার ৭৫ কোটি টাকা। বিদায়ী বছরে, অর্থাৎ ২০২২ সাল শেষে খেলাপি ঋণের হার দাঁড়িয়েছে ২৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ। টাকার অঙ্কে খেলাপি ঋণের পরিমাণ হয়েছে ১০ হাজার ৬৭০ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। এর ফলে খেলাপি ঋণের বিপরীতে বেশি পরিমাণ নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে হচ্ছে, যা ব্যাংকটিকে লোকসানে যেতে বাধ্য করেছে।