রিয়াদুল ইসলাম রিয়াদ, বাঁশখালী (চট্টগ্রাম): আলী আকবর। বাবা মকবুল আহমেদ। বয়স ১২ বছর। এক বছর ধরে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা হাতে বাঁশখালীর প্রধান সড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এই কিশোর। শুধু কি এই কিশোর? না তার পরিবারের সাত সদস্যই তিনটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালিয়ে সংসার চালাচ্ছেন। তার ভাষ্যমতে, তিনটি অটোরিকশার মধ্যে যে কোনো দুটি অটোরিকশা রাতদিন ২৪ ঘণ্টা সড়কে থাকে। অন্য একটি বিদ্যুতে চার্জে থাকে। এতে তাদের দৈনিক আয় চার-পাঁচ হাজার টাকা। আকবর দিনের বেলা গাড়ি চালালেও তার বাবা ও দুই বড় ভাই রাতের বেলা গাড়ি চালান। রাতে ভাড়াও বেশি, ইনকামও বেশি। এভাবে চলে তাদের জীবনের রুটি-রুজির পথচলা। শুধুই কি আকবর! না। ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা হাতে এমন শত শিশু-কিশোরের দেখা মেলে বাঁশখালী প্রধান সড়ক ও গ্রামীণ সড়কে।
সরেজমিনে দেখা যায়, ‘বাঁশখালীর প্রধান সড়ক ও গ্রামীণ সড়কে শুধুই ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা আর অটোরিকশা। যানবাহনের ছোটাছুটিতে ব্যস্ত বাঁশখালীর প্রধান সড়কে দাপিয়ে চলছে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাগুলো। এতে কখনও স্বল্প ও কখনও দূরপাল্লার পরিবহনের সঙ্গে পাল্লা দেয়ার চেষ্টা যাত্রীদের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। এ ছাড়া যেখানে-সেখানে যানজট লেগেই থাকে এবং সেই সঙ্গে কয়েক দিন পরপর সড়কে ছোট-বড় দুর্ঘটনা হচ্ছে। শিশু-কিশোর থেকে চোর ও মাদকসেবী সবাই যেন ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার ড্রাইভার। উপজেলার প্রধান সড়কের গুনাগরি খাসমহল, চানপুর বাজার, বাণীগ্রাম বাজার, বৈলছড়ি বাজার, মিয়ার বাজার, হাবিবের দোকান, পৌরসভা, চাম্বল বাজার, টাইমবাজার, নাপোড়া ও প্রেমবাজার দেখলেই মনে হয় এ যেন ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার স্বর্গরাজ্য। এ ছাড়া গ্রামাঞ্চলেও পরিবহন বলতে ৯০ শতাংশ অটোরিকশারই দেখা মিলে শুধু।’
বাঁশখালীতে কতসংখ্যক ওইসব ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও ইজিবাইক রয়েছে তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও উপজেলা অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়ন, বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ ও পৌরসভা এবং ইউনিয়ন-সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ‘এ উপজেলায় দুই হাজারের ওপর ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল করছে। এদিকে ওইসব ব্যাটারিচালিত রিকশার সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ায় পৌরসভাসহ বিভিন্ন স্থানে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গ্যারেজ গড়ে উঠেছে। অনেক অটোরিকশার মালিক মাসিক চুক্তিতে ওইসব গ্যারেজে রাখছেন যানবাহন। ব্যাটারি চার্জসহ গাড়ি রাখার জন্য গ্যারেজ মালিককে গাড়িপ্রতি ৮০ থেকে ১২০ টাকা দিতে হয়।’
এ ব্যাপারে সড়কে নিয়মিত চলাচল করা পরিবহন চালকরা জানান, ‘দুর্ঘটনার বড় কারণ সড়কে থাকা তিন চাকার ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাগুলো। অটোরিকশা একপ্রকার অত্যাচার শুরু করেছে। সেগুলোর জন্য আমরা গাড়ি চালাতে পারি না। তারা গ্রামীণ রাস্তায় চলাচল করলে আমাদের সমস্যা হয় না, কিন্তু প্রধান সড়কে চললে খুব সমস্যা হয়। তারা গাড়ি চালানোর বিষয়ে ন্যূনতম জ্ঞান রাখে না। পুলিশ বা প্রশাসন কেউ তাদের কিছু বলে না। এ অবস্থায় অবৈধ অটোরিকশা চলাচল বন্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার জোর দাবি জানাই।’
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে অটোরিকশা চালকরা বলেন, ‘আমরা সড়কে সুশৃঙ্খলভাবে গাড়ি চালাই। স্টেশনভিত্তিক আমাদের সমিতি রয়েছে। আমরা সেখানে দু-তিন হাজার টাকা খরচ করে ভর্তি হই। এরপর মাসিক একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ চাঁদাও দিই। তবে এখন সব জায়গায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা বেড়েই চলছে। প্রতিদিনই সড়কে নতুন নতুন গাড়ি নামাচ্ছে। বিদ্যুৎচালিত হওয়ায় কম সময়ে আয় বেশি। তাই সবাই এই গাড়ি চালাচ্ছে। প্রধান সড়কের গুরুত্বপূর্ণ বাজার এলাকায় যাত্রী বেশি থাকে। ওখান থেকে যাত্রী নিয়ে লোকাল সড়কে চলে যাই আমরা।’
অটোরিকশা চালক আব্দু ছবুর বলেন, ‘প্যাডেল রিকশার চেয়ে ব্যাটারিচালিত রিকশা চালানো সহজ। আমার ছোট ছেলে সকালে চালায়, আর আমি রাতে। ভোররাত ও দুপুরে গাড়িতে চার্জ দিই। দুবেলা চালিয়ে দুজনের আয় প্রায় এক হাজার ৩০০ থেকে এক হাজার ৪০০ টাকা হয়। কোনো নিষেধাজ্ঞা না থাকায় যেখানে-সেখানে চালানো যায়। শুধু গাড়িতে চার্জ থাকলেই হলো। অপর এক রিকশাচালক মুবিনুল হক বলেন, ‘দুই মাস অসুস্থ ছিলাম, যার কারণে দারোয়ানের চাকরিটা চলে যায়। পরে টাকা ধার করে একটা অটোরিকশা
নিই। এখন প্রতিদিন এক হাজার টাকার ওপরে ইনকাম করি। এক মাসে বিদ্যুৎ বিল দুই হাজার
টাকার মতো আসে। সমিতিতে ভর্তি ও মাসিক চাঁদা ছাড়া অন্য কোনো খরচ নেই। তাই ভালো একটা ইনকাম হয়।’
পৌরসভার বাসিন্দা মোবারক বলেন, ‘রাস্তায় অটোরিকশার জন্য চলাচল করা যায় না। সব বাচ্চা ছেলে গাড়ি চালায়, কখন যে অ্যাক্সিডেন্ট করে ফেলে বলা যায় না। ড্রাইভারদের প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যবহারিক শিক্ষা না থাকায় যাত্রীদের সঙ্গে চালকদের ঝগড়া-বিবাদ লেগেই থাকে। অদক্ষ অটোরিকশা চালকদের অনেকেই জোর করে যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করে থাকে। তাই এসব গাড়ি দ্রুত নিষিদ্ধের দাবি জানাই।’
পল্লী বিদ্যুৎ বাঁশখালী জোনাল অফিসের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (ডিজিএম) রীশু কুমার ঘোষ বলেন, ‘প্রায় সব ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা আবাসিক মিটারের চার্জেই চলে। বাঁশখালী জোনাল অফিস, গুনাগরি, বৈলছড়ি ও নাপোড়া সাবস্টেশনের মাধ্যমে দৈনিক প্রায় ৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ হয়। তার মধ্যে দুই মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার চার্জে খরচ হয়। তবে এর কারণে বিদ্যুতের তেমন সমস্যা হচ্ছে না বলে জানান তিনি।’ বাঁশখালীর ট্রাফিক সার্জেন্ট রেজাউল বলেন, ‘উপজেলা সদর, গুনাগরি ও চাম্বল বাজারে আমাদের ট্রাফিক রয়েছে। আমরা প্রধান সড়কে দেখামাত্র অটোরিকশাগুলো গ্রামীণ সড়কে ফেরত পাঠাই। তবে অটোরিকশাগুলো গ্রামীণ সড়কের মুখে অবস্থান করে, যার কারণে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায় না। তবে অনেকে গোপনে প্রধান সড়কে গাড়ি চালান। এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন স্যারকে জানানো হয়েছে। শিগগিরই ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
বাঁশখালী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সুধাংশু শেখর হালদার বলেন, ‘সরকারি নিষেধাজ্ঞায় পাত্তা না দিয়ে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়েই প্রধান সড়কে কিছু ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলছে। নতুন ওসি স্যারকে বিষয়টি জানানো হয়েছে। শিগগিরই আমরা এসবের গাড়ির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।’