খন্দকার রাহাত মাহমুদ: বিশ্বজুড়েই ভোক্তা গোষ্ঠীর ব্র্যান্ড দেখে পণ্য বা সেবা কেনার জোরালো প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। ভালো ব্র্যান্ডের পণ্য বেশি দামে কিনতে দ্বিধা করছেন না ক্রেতা। অন্যদিকে অখ্যাত ব্র্যান্ড হলে বেশিরভাগ সময়ই ভোক্তা গুণ ও মান নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, পণ্য কেনার ক্ষেত্রে দ্বিধাদ্বদ্ধে পড়েন অথবা না কিনেই ফিরে যান। কোনো ব্র্যান্ডের পণ্য বা সেবা কেনার ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ধারণা, রুচি, আচরণ, সংস্কৃতি প্রভৃতি বিবেচনায় সিদ্ধান্ত নেন ভোক্তা। তাই ভোক্তার চাহিদা মাথায় রেখেই উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো পণ্য বা সেবা বাজারজাত করে।
ব্র্যান্ডের প্রাথমিক ধারণার সঙ্গে বর্তমান যুগের ধারণার বেশ পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। প্রথমদিকে পণ্যের মোড়কে মালিক বা কোম্পানির লেবেল সেঁটে দিয়ে ব্র্যান্ড বোঝানো যেত। কিন্তু বর্তমানে ব্র্যান্ড হলো একটি নাম, স্মারকচিহ্ন, প্রতীক, নকশা; বিশেষ করে এগুলোর সমন্বয়ে গঠিত কোনো রূপ, যার মাধ্যমে কোনো কোম্পানি বাজারে বিদ্যমান প্রতিযোগী হতে নিজের পণ্য বা সেবাকে আলাদাভাবে উপস্থাপন করে। ব্র্যান্ডিং হলো একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়ায় কোনো প্রতিষ্ঠান প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে তুলতে চেষ্টা করে। কোম্পানিগুলো যেহেতু বহুদিন ব্যবসা করতে চায়, সেহেতু ভোক্তার কাছে পণ্যের চাহিদা, গ্রহণযোগ্যতা, পণ্যের মান, সুখ্যাতি প্রভৃতি ধারাবাহিকভাবেই বৃদ্ধি করতে বাধ্য থাকে। কোনো কোম্পানি ক্রেতাকে কীভাবে মূল্যায়ন করছে, ক্রেতার আকাক্সক্ষা তার পণ্য কতটা পূরণ করছে, কতটা মানসম্পন্ন পণ্য বাজারে আসছে, ভোক্তা কোন পণ্যকে কীভাবে চাইছে, কোম্পানি হিসেবে কতটা সামাজিক দায়বদ্ধতা পালন করছে, শ্রমিকের শ্রমকে কীভাবে মূল্যায়ন করা হচ্ছে প্রভৃতি বৈশিষ্ট্যের সমন্বয় কোনো পণ্য বা সেবার মধ্যে প্রকাশিত হলে তখন তা আদর্শ ব্র্যান্ড হিসেবে পরিচিতি পেতে থাকে। একটি ব্র্যান্ড তৈরিতে সৃষ্টিশীল মানুষের প্রয়োজন।
বাংলাদেশ নিয়ে যারা স্বপ্ন দেখেন, দেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে যারা কাজে লাগাতে চান, তারা বর্তমানে ব্র্যান্ডিং নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। উন্নত দেশের ভোক্তারা পণ্য বা সেবা কেনার ক্ষেত্রে পণ্যের গুণ-মান ও কোম্পানির সুনামকে গুরুত্ব দিলেও বাংলাদেশের ভোক্তাদের ক্ষেত্রে বিষয়টি একটু আলাদাভাবে উপস্থাপিত হয়। আমাদের বাজারে ব্র্যান্ডের ক্ষেত্রে শুধু পণ্যের গুণগত মান, বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান বা উৎপাদনকারী কোম্পানিই জড়িত নয়, এর সঙ্গে এদেশের সংস্কৃতির একটা নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। টাঙ্গাইলের চমচম বা তাঁতের শাড়ি, মিরপুরের বেনারসি, রাজশাহীর সিল্ক, বগুড়ার দই, ফখরুদ্দিনের কাচ্চি, কুমিল্লার রসমালাই, পদ্মার ইলিশ, রাজশাহীর আম প্রভৃতি যেন একেকটি ব্র্যান্ড। আপনি যখনই এসব পণ্যের কথা ভাববেন, তখনই স্মৃতিপটে একটি চিত্রকল্প এসে যাবে অজান্তে। বগুড়ায় বেড়াতে গেলে দইয়ের স্বাদ না নিলে যেমন বেড়ানোটা অসম্পূর্ণ থেকে যায়, তেমনি রাজশাহীতে গেলেন; কিন্তু গৃহিণীর জন্য সিল্ক-শাড়ি কিনলেন না তাহলে রাজশাহী ভ্রমণ যেন পূর্ণতা পাবে না। বাংলার নকশীকাঁথার কথা ভেবে দেখুন, প্রযুক্তিনির্ভর বর্তমান দুনিয়ায় সূচিশৈলীর এ পণ্যের আবেদন যেন দিন দিন আরও বেড়ে চলেছে।
চট্টগ্রামের হাটহাজারীর জোবরা গ্রাম হতে শুরু হওয়া গ্রামীণ ব্যাংক আজ নিজেই একটি ব্র্যান্ডে পরিণত হয়েছে। গ্রামীণ ব্যাংক বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। নারীর ক্ষমতায়নে গ্রামীণ ব্যাংক বেশ জোরালো ভূমিকা রেখেছে। গ্রামীণ ব্যাংকের ‘গ্রামীণ’ শব্দটি নিয়ে গ্রামীণফোন ব্র্যান্ড তৈরি করল। আজ তারা বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানি।
পাটকে বলা হয় সোনালি আঁশ। এক সময় বিশ্ববাসী সোনালি আঁশের দেশ বলতে বাংলাদেশকে চিনত, জানত। সে পাটশিল্প আজ প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে বললেই চলে। পাটের ব্যবহার বর্তমানে বস্তা, চট, দড়ি, কারপেটের মধ্যেই যেন সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকির মুখে দূষণমুক্ত বিশ্ব গড়তে হলে পরিবেশবান্ধব পাটের কথা গুরুত্বসহকারে ভাবতে হবে। মেধা ও বর্তমান প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে পাটকে বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিংয়ের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।
২০১৪ সালে বিদেশি ও দেশি কোম্পানিগুলোকে তাদের পণ্য ভারতে তৈরি করতে আগ্রহী করার জন্য ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ নামের ব্র্যান্ডিংয়ের উদ্যোগ নেয় ভারত সরকার। বলা হয়ে থাকে এ উদ্যোগের ফলেই আমেরিকা ও চীনকে ডিঙিয়ে ভারত বিদেশি বিনিয়োগের জন্য সেরা দেশের তকমা পায়। দেশপ্রেম নিয়ে কাজ করলে দেশকে এগিয়ে নেওয়া যায় বৈকি। শ্রীলঙ্কা তার দেশকে ‘রিফ্রেশিং শ্রীলঙ্কা’ হিসেবে বিশ্বের কাছে তুলে ধরছে। মালয়েশিয়া ‘ট্রুলি এশিয়া’, থাইল্যান্ড ‘অ্যামেজিং থাইল্যান্ড’, চীন ‘সারা বিশ্বের কারখানা’ হিসেবে নিজেদের তুলে ধরছে। সিঙ্গাপুরের জাতীয় আয়ের ৭৫ শতাংশ আসে পর্যটন খাত থেকে আর আমাদের আসে মাত্র দুই শতাংশের মতো। অথচ আমাদের নিজেদের বিশ্বের সামনে তুলে ধরার মতো অনেক কিছু আছে। আমাদের আছে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত। সুন্দরবনের মতো প্রকৃতির এক অভাবনীয় অবদান রয়েছে আমাদের ভূ খণ্ডে। জাফলং, তামাবিল, সেন্টমার্টিনস দ্বীপের মতো অবকাশ যাপনের স্থান, ‘জলাবরণ’ খ্যাত রাতারগুল, ‘জলপাথরের শয্যা’ খ্যাত বিছানাকান্দি, রেইন ফরেস্ট লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, সাজেকের মতো মনোমুগ্ধকর ও দৃষ্টিনন্দন অনেক প্রাকৃতিক জায়গা আমাদের আছে, যা পর্যটনের ক্ষেত্রে ব্র্যান্ডিংয়ের ভালো উপাদান। পোশাকশিল্পে বাংলাদেশের চমকপ্রদ সাফল্য আছে। ওষুধশিল্পেও আমাদের অবস্থান শক্তিশালী। বিশ্বের প্রায় ১৬০ দেশে বাংলাদেশ হতে ওষুধ রফতানি হচ্ছে। তবে আমরা কেন পিছিয়ে? অবশ্য আমাদের সমস্যা অনেক। কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছাতে হলে সমস্যার মধ্য দিয়েই যেতে হবে। নেতিবাচক দিকগুলো পেছনে ফেলে বিশ্বের কাছে ইতিবাচক বাংলাদেশকে তুলে ধরতে হবে।
জাপান, জার্মানি, কোরিয়ায় তৈরি পণ্যের মান ভালো হবে এমন ধারণা অনেক ক্রেতাই পোষণ করেন। ইরাক, আফগান যুদ্ধের মতো নানা কারণে যুক্তরাষ্ট্রকে অনেকে মনে মনে ভিন্ন চোখে দেখলেও ‘মেইড ইন আমেরিকা’র পণ্যের প্রতি আস্থার যেন কমতি নেই। যুক্তরাষ্ট্রই বলুন আর জাপান-জার্মানিই বলুন, কেউই দ্রুত এ অবস্থান তৈরি করতে পারেনি। দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টাতেই তাদের এমন ইতিবাচক ইমেজ তৈরি হয়েছে।
আমাদের রয়েছে প্রচুর জনশক্তি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় এক কোটি প্রবাসী বাংলাদেশির বসবাস। তারাও ইতিবাচক ইমেজ তৈরি করে দেশের জন্য ব্র্যান্ডিংয়ের কাজ করতে পারেন। সেজন্য দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বজায় রেখে ব্র্যান্ডের শক্তি বাড়ানোর ওপর যেমন জোর দিতে হবে, তেমনি বিদেশে বাজার সৃষ্টি ও তা ধরে রাখতে এ দেশের উৎপাদিত পণ্যের গুণগত মান ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধিতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। বাংলাদেশের জন্য একটি গ্রহণযোগ্য ব্র্যান্ড ইমেজ তৈরি করতে হলে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য, গণমাধ্যমের ইতিবাচক ভূমিকা, বিদেশে কর্মরতদের বাংলাদেশের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর মনে করে কাজ করতে হবে। বিদেশে শুধু অদক্ষ বা আধাদক্ষ জনশক্তি রফতানি না করে দক্ষ, শিক্ষিত জনশক্তি পাঠানোর উদ্যোগ নিতে হবে। তবেই না বাংলাদেশকে ব্র্যান্ডিং করা হবে, বিশ্ববাজারের ভোক্তাসাধারণের মনে এ দেশের ব্র্যান্ড-পণ্যকে ইতিবাচক হিসেবে তুলে ধরা হবে।
ব্যাংকার ও কলাম লেখক
champookgmÍgmail.com