নিউইয়র্কে চলমান জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানরা যোগ দিলেও রোহিঙ্গা শরণার্থী ইস্যুতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন স্বভাবতই মনোযোগের কেন্দ্রে। ওখানে দেওয়া ভাষণের একটি উল্লেখযোগ্য সময় রোহিঙ্গা ইস্যুতে কথা বলেছেন তিনি। বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেছেন নিপীড়নের শিকার হয়ে প্রতিবেশী মিয়ানমার থেকে আসা এ জনগোষ্ঠীর অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশার কথা। সম্প্রতি শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করে তিনি যে দুঃখভারাক্রান্ত হয়েছেন, সেটাও উল্লেখ করেছেন ভাষণে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর মিয়ানমারে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন যে বাংলাদেশের জন্যও আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে নানা সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, সে বার্তা তিনি পৌঁছে দিয়েছেন জাতিসংঘে। আমরা আশা করি, অধিবেশনে উপস্থিত সরকারপ্রধানরা আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ভাষণকে গুরুত্বসহ নেবেন এবং এ সমস্যার কীভাবে স্থায়ী সমাধান করা যায়, সে ব্যাপারে মত দেবেন তাদের বক্তব্যে। এর মাধ্যমে মিয়ানমার সরকারের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টির পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের নিজ বাসভ‚মিতে ফেরানোর ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও অগ্রগতি অর্জন করা যাবে।
বস্তুত রোহিঙ্গা ইস্যুতে সুনির্দিষ্ট পাঁচটি প্রস্তাব তুলে ধরেছেন প্রধানমন্ত্রী। এতে মিয়ানমারে ‘জাতিগত নিধন’ স্থায়ীভাবে বন্ধের প্রস্তাব যেমন রয়েছে, এ দেশে আসা শরণার্থীদের মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসনের বিষয়টিও তেমনি স্থান পেয়েছে। নিপীড়নের শঙ্কামুক্ত হলে শরণার্থীদের যে ফেরত পাঠানো সম্ভব, সেটা আমরা আগেও দেখেছি। সন্দেহ নেই, পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার মাধ্যমে এখনও তাদের ফেরত পাঠানো সম্ভব। এর সমর্থন মেলে বিশেষজ্ঞদের বক্তব্যেও। এ লক্ষ্যে যথাযথ পরিবেশ সৃষ্টির জন্য প্রধানমন্ত্রী দেশটিতে জাতিসংঘ মহাসচিবের নিজস্ব অনুসন্ধানী দল প্রেরণের পাশাপাশি সংস্থাটির তত্ত¡াবধানে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সব নাগরিকের জন্য ‘সুরক্ষা বলয়’ গঠন ও কফি আনান কমিশনের সুপারিশগুলো নিঃশর্ত ও পরিপূর্ণরূপে এবং দ্রুত বাস্তবায়নের আহবান জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর এসব প্রস্তাব যথার্থ এবং এগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি বাংলাদেশেরও স্বার্থরক্ষা হবে। এও ঠিক, প্রক্রিয়াটি ত্বরান্বিত করতে গেলে যোগাযোগ করতে হবে প্রত্যেক বন্ধুরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে। তাদের বোঝাতে হবে বাংলাদেশের বাস্তবতা। ঘনবসতিপূর্ণ ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল একটি দেশের পক্ষে যে ৮-১০ লাখ শরণার্থীর ভার দীর্ঘকাল বহন সম্ভব নয়, সে বার্তা দিতে হবে বিশ্বনেতাদের। এ লক্ষ্যে ক‚টনৈতিক পর্যায়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপও কাম্য।
ভাষণে প্রধানমন্ত্রী জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় তার সরকারের দৃঢ় অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছেন। জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ বিস্তারের কারণে যে উন্নয়ন ব্যাহত হয়, সেটা কে না জানে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে গতিতে উন্নতি লাভ করছে, সেটা ধরে রাখার পাশাপাশি সক্ষমতার নতুন মাইলফলক অর্জনে জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ কঠোরভাবে মোকাবিলা করা প্রয়োজন, সেটাও জানা কথা। এ দেশে আসা রোহিঙ্গাদের একাংশ যে এ ধরনের কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়ে পড়ছে, সে অভিযোগ পুরোনো। এটা শুধু বাংলাদেশ নয়, এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতাই ব্যাহত করবে। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসনের সতর্ক ভ‚মিকাও কাম্য। কোনো গোষ্ঠী বঞ্চনার শিকার হলে তাদের মধ্যে এমন কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা বেড়ে ওঠে। রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার নিশ্চিত না হলে এ জনগোষ্ঠীকে বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যক্রম থেকে বিরত রাখা সত্যি কঠিন হবে। আঞ্চলিক সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় কঠোর মনোভাব পোষণকারী কোনো কোনো বন্ধু ও শক্তিধর রাষ্ট্র এ বাস্তবতা উপলব্ধি করেও এখন হাঁটছে উল্টোপথে। এ অঞ্চলে জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় মিয়ানমারে স্থিতিশীলতা সৃষ্টিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর আহবানকে তারা যেন নেন গুরুত্বের সঙ্গে।
Add Comment