মো. জিল্লুর রহমান: বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্য হয় মূলত চারটি অঞ্চলে উত্তর আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), চীন ও ভারত। প্রথম দুটি অঞ্চলে আমাদের পণ্য রপ্তানি বেশি আর বাকি দুই দেশ অর্থাৎ ভারত ও চীন থেকে আমদানি বেশি। কারণ, দেশ দুটি থেকে আমদানি কাঁচামাল ব্যবহার করে উৎপাদিত পণ্যই যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউতে রপ্তানি করা হয়। আর ভারত-চীন থেকে আমদানির কারণ, দামে সস্তা ও তুলনামূলক কম সময়ে পাওয়া যায়। বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের বাজারকে লক্ষ্য করেই গড়ে উঠেছে। সমস্যা হচ্ছে বাংলাদেশ রপ্তানিতে পণ্য ও বাজার বহুমুখীকরণ করতে পারেনি। এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের পর রপ্তানির ওপর চাপ তৈরি হবে। কিন্তু চীন, ভারতসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো আমাদের পণ্য রপ্তানির জন্য সম্ভাবনাময় বাজার হতে পারে।
বাংলাদেশের রপ্তানির সবচেয়ে বড় একক বাজার যুক্তরাষ্ট্র। অনেক দিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্র একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় বাজার। মাঝে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে জার্মানি বাংলাদেশি পণ্যের শীর্ষ গন্তব্য হলেও সেটি বেশি দিন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে পণ্য রপ্তানির ২০ শতাংশই হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে। বাকি মোট পণ্য রপ্তানির ৪৪ দশমিক ৬০ শতাংশের গন্তব্য ইইউ। এই বাজারে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা রয়েছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মোট ৫ হাজার ২০৮ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছিল, যার মধ্যে শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই গেছে ১ হাজার ৪২ কোটি ডলারের পণ্য। এর মধ্যে তৈরি পোশাকই ছিল ৮৬ শতাংশ, যা পরিমাণে ৯০১ কোটি ডলার। এছাড়া ৩১ কোটি ডলারের হোম টেক্সটাইল রপ্তানি রয়েছে। একই সময়ে জার্মানিতে ৭৫৯ কোটি ডলার, যুক্তরাজ্যে ৪৮৩ কোটি ডলার, ফ্রান্সে ২৭১ কোটি ডলার এবং স্পেনে ৩১৭ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এই চার দেশের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানিতে সর্বোচ্চ ৪৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ছিল। পরের বছর অর্থাৎ ২০২২-২৩ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রে মোট ৯৭০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি একদিকে বাড়ছে, অন্যদিকে আমদানি কমছে। ফলে বাণিজ্য পরিস্থিতি বাংলাদেশে অনুকূলে থাকার প্রবণতাও বাড়ছে। বর্তমানে আমদানির চেয়ে সাড়ে তিন গুণ বেশি পণ্য বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি যাচ্ছে তৈরি পোশাক। ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ১ হাজার ৪২ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করা হয়েছে, যা মোট রপ্তানির ২০ শতাংশ এবং একই সময়ে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২৮৩ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে, যা দেশের মোট আমদানির ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত কয়েক বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশের আমদানির হার কমছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ৩৯৮ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করা হয়েছে, যা মোট রপ্তানির ১৫ দশমিক ১ শতাংশ এবং এর বিপরীতে বাংলাদেশ ২২৬ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে, যা দেশের মোট আমদানির ৪ দশমিক ৬ শতাংশ। গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যে উদ্বৃত্ত ছিল ১৭২ কোটি ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরে তা আরও বেড়ে উদ্বৃত্তের পরিমাণ দাঁড়ায় ২৬৮ কোটি ডলার। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে তা ৪৫৭ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে।
পক্ষান্তরে বাংলাদেশের পণ্য আমদানির সর্বোচ্চ ৪৩ শতাংশ আসে ভারত ও চীন থেকে এবং সে তুলনায় দেশ দুটিতে রপ্তানি খুবই নগণ্য, মাত্র ৫ শতাংশ। ফলে ভারত ও চীনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে বাংলাদেশ বেশ পিছিয়ে রয়েছে, অর্থাৎ অনেকটা আমদানিনির্ভর। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৭,৫৬০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে, তার মধ্যে চীন থেকে সবচেয়ে বেশি ২৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ অথবা ১ হাজার ৯৩৫ কোটি ডলারের পণ্যই আমদানি হয়েছে। তারপরই ভারতের অবস্থান, দেশটি থেকে আমদানি হয়েছে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১ হাজার ৩৬৯ কোটি ডলারের পণ্য, যা মোট আমদানির ১৮ দশমিক ১১ শতাংশ।
চীন থেকে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি আমদানি করে শিল্পকারখানার যন্ত্রপাতি। দেশটি থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর ৪২৫ কোটি ডলারের যন্ত্রপাতি আমদানি হয়েছে। তারপর সবচেয়ে বেশি আমদানি হয়েছে বস্ত্র খাতের কাঁচামাল তুলা এবং এর পরিমাণ ২২৮ কোটি ডলার। এছাড়া ১৯১ কোটি ডলারের ইলেকট্রনিক পণ্য, ১৩৭ কোটি ডলারের নিট কাপড়, ১২২ কোটি ডলারের কৃত্রিম তন্তু আমদানি হয়েছে। অন্যদিকে ভারত থেকে বর্তমানে তুলা আমদানি হচ্ছে বেশি। ২০২১-২২ অর্থবছর দেশটি থেকে মোট আমদানির ৩১ শতাংশ ছিল তুলা যার পরিমাণ হিসাবে ৪২২ কোটি ডলার। এছাড়া ২২১ কোটি ডলারের শস্য, ৭৭ কোটি ডলারের মোটরযান, ৫৭ কোটি ডলারের চিনি ও চিনিজাতীয় পণ্য, ৫৪ কোটি ডলারের জীবাশ্ম জ্বালানি আমদানি হয়েছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছর বাংলাদেশ থেকে ৫ হাজার ২০৮ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়। তার মধ্যে ভারতে রপ্তানির পরিমাণ ছিল মাত্র ১৯৯ কোটি এবং চীনে ৬৮ কোটি ডলার। এদিকে ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে ৪ হাজার ৫৬৮ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। তার মধ্যে ভারতে ১৮৩ কোটি এবং চীনে ৫৩ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। সাউথ এশিয়ান ফ্রি ট্রেড এরিয়া (সাফটা) চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ ভারতে ২৫টি পণ্য ছাড়া সব পণ্যে শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা পায়। এ ছাড়া চীনের বাজারে ৯৯ শতাংশ পণ্যেই শুল্কমুক্ত সুবিধা আছে। তার পরও দেশ দুটিতে যে রপ্তানি হচ্ছে, তা মোট পণ্য রপ্তানির মাত্র ৫ শতাংশের কাছাকাছি। যদিও স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যুক্ত হলে দেশ দুটিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা থাকবে না। তখন বাংলাদেশ সরকারকে এ ধরনের সুবিধা পেতে হলে উভয় দেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য বা অন্য কোনো চুক্তি করতে হবে।
চীন ও ভারত থেকে প্রবাসী আয় উল্লেখযোগ্য মাত্রায় নয়। প্রবাসী আয় আসা শীর্ষ ৩০ দেশের মধ্যে দেশ দুটির নাম নেই। এছাড়া বাংলাদেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগে (এফডিআই) শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে চীন ও ভারত থাকলেও উভয় দেশের মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ২০৩ কোটি ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ২০২১-২২ বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে ২ হাজার ১১৬ কোটি ডলারের এফডিআই এসেছে। তার মধ্যে চীনের বিনিয়োগ ১৩৫ কোটি ডলার আর ভারতের বিনিয়োগের পরিমাণ ৬৯ কোটি ডলার। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে রাশিয়ায় ৬৩ কোটি ৮৩ লাখ ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি হয়েছিল। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ৬৬ কোটি ৫৩ লাখ ডলার রপ্তানি এবং একই সময়ে ৬৭ কোটি ৪৬ লাখ ডলার মূল্যের পণ্য আমদানি হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে রাশিয়ায় রপ্তানি ছিল ৪৮ কোটি ৭০ লাখ ডলারের পণ্য এবং একই সময়ে রাশিয়া থেকে আমদানির পরিমাণ ছিল ৭৮ কোটি ২০ লাখ ডলারের পণ্য। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগে বার্ষিক পোশাক রপ্তানি ৩৬ শতাংশ বেড়েছিল। তখন বাংলাদেশি পোশাক রপ্তানিকারকরা বার্ষিক ১ বিলিয়ন ডলার রপ্তানির বিষয়ে আশাবাদী ছিল। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পণ্য রপ্তানিতে অসুবিধা হওয়ায় ২০২২-২৩ অর্থবছরের ১১ মাসে রাশিয়ায় বাংলাদেশের রপ্তানি প্রায় ৩০ শতাংশ কমে ৪৩ কোটি ২০ লাখ ডলারে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে ভেঙে গেছে রাশিয়ায় ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি পণ্য রপ্তানির স্বপ্ন।
২০১৩ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী রাশিয়া সফরের সময় তিনটি চুক্তি সই হয়। দুটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণবিষয়ক, আরেকটি বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটারে পারমাণবিক শক্তিসংক্রান্ত তথ্যকেন্দ্র স্থাপন নিয়ে। রাশিয়ার অর্থায়নে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার দুটি আলাদা বিদ–্যৎ প্রকল্পের কাজ চলছে। এতে রাশিয়ার অর্থায়নের পরিমাণ ১ হাজার ২৬৫ কোটি ডলার, যার ৯০ শতাংশই ঋণ এবং ঋণের সুদও উচ্চ ৪ শতাংশ। চুক্তি অনুযায়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রের সব কাজ করছে রাশিয়ারই কোম্পানি। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ করছে রাশিয়ার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অ্যাটমস্ট্রয় এক্সপোর্ট। রাশিয়া সরকারই প্রতিষ্ঠানটিকে নিয়োগ দিয়েছে। ইউক্রেনে হামলার পর পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার ওপর বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ফলে এই প্রকল্পের ঋণের কিস্তি পরিশোধে তৈরি হয়েছে জটিলতা।
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে বাংলাদেশের জন্য সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআইয়ের প্রধান উৎস। ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের স্থিতি ২ হাজার ২৪ কোটি ডলার, এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ যুক্তরাষ্ট্রের ৩৫০ কোটি ডলার। যেসব খাত ও সেবায় এসব বিনিয়োগ রয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে গ্যাস ও পেট্রোলিয়াম, বস্ত্র শিল্প, ব্যাংকিং, বিদ্যুৎ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং বিমা। বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের বড় বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে জ্বালানি খাতের শেভরন ও এক্সিলারেট এনার্জি, বিমা খাতের মেটলাইফ, ব্যাংক খাতে সিটি ব্যাংক এনএ। স্বাধীনতার পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন অংশীদার। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের তথ্যানুযায়ী, গত ৫০ বছরে দেশটি বাংলাদেশকে প্রায় ৮০০ কোটি ডলারের উন্নয়ন সহায়তা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশকে এখন সবচেয়ে বেশি অর্থ সহায়তা দেয়।
বর্তমানে প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান দ্বিতীয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে ২ হাজার ১০৩ কোটি ডলারের প্রবাসী আয় আসে এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৪৫৪ কোটি ডলারের জোগানদাতা ছিলেন সৌদি আরব। তারপরের স্থানটিই যুক্তরাষ্ট্রের, সেখান থেকে আসে ৩৪৬ কোটি ডলার। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিট্যান্স এসেছে ৫১ কোটি ১৭ লাখ ডলার, যা মোট রেমিট্যান্সের ১০ দশমিক ৪১ শতাংশ এবং মোট রেমিট্যান্স আসার মধ্যে অবস্থান চতুর্থ। ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে রেমিট্যান্স আহরণে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ছিল শীর্ষে। তাছাড়া, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশটি থেকে ১৬৯ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল, যা মোট রেমিট্যান্সের ১৩ দশমিক ২৩ শতাংশ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আসে ১২০ কোটি ডলার, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১৮৪ কোটি ডলার, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২৪০ কোটি ডলার, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩৪৬ কোটি ডলার, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩৪৪ কোটি ডলার, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩৫২ কোটি ডলার, যা মোট রেমিট্যান্সের ১৬ দশমিক ৩০ শতাংশ। অর্থাৎ গত ৬ বছরে দেশটি থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি।
অভিবাসনের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র একসময়ে ছিল উচ্চশিক্ষিত বাংলাদেশিদের পছন্দের গন্তব্য। তবে ডিভি লটারির কল্যাণে বিপুলসংখ্যক সাধারণ মানুষও যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসনের সুযোগ পায়। পরে ফ্যামিলি ভিসার সুবাদে দেশটিতে বাংলাদেশিদের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র আদমশুমারি ব্যুরোর ২০১৮ সালের আমেরিকান কমিউনিটি জরিপের তথ্যানুসারে, সে সময় ২ লাখ ১৩ হাজার ৩৭২ বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মানুষ যুক্তরাষ্ট্রে বাস করতেন। সাম্প্রতিক সময়ে বাড়ছে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা। তাদের অনেকে শিক্ষাজীবন শেষ করে ভালো চাকরি করছেন এবং দেশেও টাকা পাঠাচ্ছেন। বাংলাদেশ থেকে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী এখন যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছেন পড়াশোনার জন্য। ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস জানিয়েছে, ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে রেকর্ডসংখ্যক শিক্ষার্থী বাংলাদেশ থেকে পড়াশোনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন। এ সংখ্যা ছিল ১৩ হাজার ৫৬৩, যা আগের শিক্ষাবর্ষের তুলনায় ২৮ শতাংশ বেশি। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্যুরো অব এডুকেশন অ্যান্ড কালচারাল অ্যাফেয়ার্সের করা ২০২৩ সালের ওপেন ডোরস রিপোর্টের উদ্ধৃতি দিয়ে মার্কিন দূতাবাস বলছে, ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে যেসব দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী গেছেন, বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম। তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৩তম।
বাংলাদেশ মূলত আমদানিনির্ভর দেশ। এখানে রপ্তানি আয়ের তুলনায় আমদানি ব্যয় অনেক বেশি। বাংলাদেশ মোট আমদানির প্রায় অর্ধেক আসে চীন ও ভারত থেকে। ফলে যে বাণিজ্য ঘাটতি হয়, তা পূরণ করতে হয় মূলত প্রবাসী আয় দিয়েই। রপ্তানি ও প্রবাসী আয় ছাড়াও দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের আর দুটি উৎস হচ্ছে বৈদেশিক বিনিয়োগ ও ঋণ। এই বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের (এফডিআই) ক্ষেত্রেও শীর্ষ স্থানে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশ ব্যাংক ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট পণ্য রপ্তানির ২০ শতাংশেরই গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র। বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) ১৯ শতাংশ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগকারীরা। আর ১৬ শতাংশ প্রবাসী আয় আসছে সেখান থেকে। অন্যদিকে মোট পণ্য আমদানির পৌনে ৪ শতাংশ আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে।
অর্থনীতি এখনও নানা সংকটে। কমছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। ডলারের দাম এখনও বেশি। বেড়েছে মূল্যস্ফীতির চাপ। এর মধ্যেও রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি কিছুটা হলেও স্বস্তি দিচ্ছে সরকারকে। আবার একই সময়ে কমেছে আমদানি ব্যয়। এতেই চলতি হিসাবের ঘাটতি কমেছে এক-চতুর্থাংশ। অথচ ২০২১-২২ অর্থবছরেই দেশের চলতি হিসাবের ঘাটতি ছিল গত ৫১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) বাজারই বাংলাদেশের রপ্তানি আয়কে বাঁচিয়ে রেখেছে। এর মধ্যে অবশ্য একক বাজার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানই শীর্ষে। অন্যদিকে প্রবাসী আয়ে বরাবরই শীর্ষে থাকত সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। তবে দুই অর্থবছর ধরে এখন আরব আমিরাতকে হটিয়ে দ্বিতীয় স্থান দখল করে নেয় যুক্তরাষ্ট্র। শোনা যাচ্ছে আগামী জাতীয় নির্বাচনের পর মার্কিন বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে। তাই উপরোক্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চীন, ভারত ও রাশিয়া বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যতই মাতামাতি করুক না কেন, সব মিলিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মার্কিন বাণিজ্যের প্রভাব অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। কারণ চীন, ভারত ও রাশিয়া অনেকটা আমদানিনির্ভর এবং যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন রপ্তানিনির্ভর। এজন্য সম্ভাব্য মার্কিন নিষেধাজ্ঞাকে মোকাবিলা করা সরকারের জন্য কঠিন হবে।
ব্যাংকার ও কলাম লেখক
zrbbbp@gmail.com