নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশের মৌলিক অর্থনীতিতে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ‘বাংলাদেশ ব্যাংক পুরস্কার, ২০২০’ পেয়েছেন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, এত দিন যে উন্নয়নের সাফল্য পেয়েছি, সেখানে সাধারণ মানুষের ভূমিকা ছিল। উন্নয়নের একটা বড় বৈশিষ্ট্য হলো এখানকার কৃষক, ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বড় শিল্প উদ্যোক্তারা যখন যে সুযোগ পেয়েছে, তার পূর্ণ ব্যবহার করেছে। আর সরকার এক্ষেত্রে নীতি সহায়তা দিয়েছে। এটিই হলো বাংলাদেশের সাফল্যের মূলকথা। এখানকার গরিবদের মধ্যেও উন্নয়নের একটা আকাক্সক্ষা রয়েছে। উন্নয়নের আকাক্সক্ষাটা একটা বড় সুযোগ। স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে হয়তো এই আকাক্সক্ষা এসেছে।
বাংলাদেশের মৌলিক অর্থনীতিতে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদকে গতকাল রাতে ‘বাংলাদেশ ব্যাংক পুরস্কার, ২০২০’ দেয়া হয়। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) আয়োজিত এ সম্মাননা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। সভাপতিত্ব করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির। বক্তব্য দেন ডেপুটি গভর্নর কাজী ছাইদুর রহমান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক নাজমা বেগম। পুরস্কার হিসেবে তার হাতে স্বর্ণপদক, ক্রেস্ট ও পাঁচ লাখ টাকা তুলে দেন অর্থমন্ত্রী ও গভর্নর।
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়ন সাফল্য নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। তবে মনে রাখতে হবে, উন্নয়নের কৌশল সবসময় সমান উপযোগী হতে হয়। সময়ে সময়ে পরিবর্তন ও পরিবর্ধন প্রয়োজনে করতে হয়। উচ্চ ফলন শস্যে প্রযুক্তির ব্যবহার, বিদেশে শ্রমবাজারের সুযোগ, তৈরি পোশাক রপ্তানি, ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সুযোগÑএসব ছিল এর মধ্যে। এর সঙ্গে আরও একটি বিষয় হলো বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে উন্নয়নের আকাক্সক্ষা আছে। এটা অন্য দেশের মানুষের মাঝে নেই। এই উন্নয়নের আকাক্সক্ষা একটা বড় শক্তি। এটা হয়তো মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে এসেছিল, এখনও আছে।
তিনি বলেন, ‘আমি এই পুরস্কার নিতে কিছুটা অস্বস্তি বোধ করছি, কারণ এই পুরস্কার প্রবর্তনের সঙ্গে আমি ও সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন যুক্ত ছিলাম। তবে স্বস্তির বিষয় হলো স্বাধীনতার ৫০ বছরে এই পুরস্কার পাচ্ছি। আমি বাংলাদেশ ব্যাংকে দেড় দশক ছিলাম, যে কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার বাইরে বাংলাদেশ ব্যাংককে দ্বিতীয় কর্মস্থল বলে মনে করি।’
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘আমরা উন্নয়নের নতুন পর্যায়ে পৌঁছেছি, বিশ্ব অর্থনীততিও বদলে যাচ্ছে। এই উন্নয়নে নানা চ্যালেঞ্জ আছে। প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, মানসম্পন্ন শিক্ষা ও উপযুক্ত শিক্ষার মাধ্যমে মানবসম্পদ তৈরি করা, যাতে ডেমোগ্রাফিক সুবিধা নিতে পারি। প্রশাসনের দক্ষতা ও জবাবদহি বাড়ানো। বিশ্ব আর্থিক অস্থিরতা সামাল দেয়ার জন্য উন্নতমানের আর্থিক খাত গড়ে তোলা। এলডিসি থেকে উত্তরণের পর বিশ্ববাণিজ্যে সুবিধা নিতে ও টিকে থাকতে এই চ্যালেঞ্জগুলো আমাদের আছে।’
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ আরও বলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন কীভাবে হয়, এতদিন এ নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। তবে এখন বিশ্ব অর্থনীতবিদরা প্রায় সবাই একমত যে, উন্নয়নের কোনো ধরাবাঁধা ছক নেই। এমনকি বিশ্বব্যাংক ২০১৬ সালে এক প্রতিবেদনে বলেছে, একই নীতি ভিন্ন ভিন্ন দেশে ভিন্ন ফলাফল দেয়। এজন্য অন্য দেশের মডেল অনুসরণ করে লাভ নেই। নিজেদের অভিজ্ঞতার আলোকে নিজেদের উন্নয়ন মডেল করতে হবে। আমাদের পূর্ব এশিয়ার টাইগার না হয়ে এজন্য রয়েল বেঙ্গল টাইগার হতে হবে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, দেশের অর্থনীতির সব সূচক আশানুরূপ হয়েছে। এই বছরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৫০ বিলিয়ন ডলার হওয়ার আশা করেছিলাম, সেটা হয়নি। তবে চলতি অর্থবছরে রিজার্ভ ৫০ বিলিয়ন ডলার হবে। তিনি বলেন, দেশের জিডিপির তুলনায় আমাদের বিদেশি ঋণ খুব কম, মাত্র ৩৬-৩৭ শতাংশ। এত কম ঋণ কোনো দেশের নেই। আমরা এখন রিজার্ভ থেকে ঋণ দেয়া শুরু করেছি। মেগা প্রকল্পেও রিজার্ভ থেকে ঋণ পাচ্ছে।
অনুষ্ঠানে দেশের অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা উপস্থিত ছিলেন। এর আগে ‘বাংলাদেশ ব্যাংক পুরস্কার, ২০১৭’ যৌথভাবে দেয়া হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, রিভারসাইডের ইমেরিটাস অধ্যাপক আজিজুর রহমান খান ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও ব্র্যাকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক মাহবুব হোসেনকে (মরণোত্তর)। আজিজুর রহমান খান স্বাধীনতার পর পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের প্রধান হিসেবে প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
প্রসঙ্গত, অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ ১৯৪৮ সালের ১ জুলাই নোয়াখালী জেলায় জš§গ্রহণ করেন। ১৯৬৩ সালে এসএসসি এবং ১৯৬৫ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় রেকর্ড নম্বর পেয়ে সম্মিলিত মেধাতালিকায় তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন। ১৯৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে সম্মান ডিগ্রি নেন। ১৯৭৭ সালে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি নেন। ১৯৬৯ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। তিনি সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন। তিনি বর্তমান সরকারের ‘রূপকল্প-২০৪১’-সংক্রান্ত জাতীয় পরামর্শ কমিটির চেয়ারম্যান।