Print Date & Time : 18 June 2025 Wednesday 1:28 am

বাংলাদেশের ওপর অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক বহাল রাখছে ভারত!

নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশের পাটপণ্যে রপ্তানিতে অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক আরোপ করেছে ভারত। ২০১৭ সালে পাঁচ বছরের জন্য এ শুল্ক আরোপ করা হয়, যা চলতি বছর শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। পণ্যভেদে টনপ্রতি শুল্কারোপ করা হয় ৬ দশমিক ৩০ থেকে ৩৫১ দশমিক ৭২ ডলার। চলতি বছর এ শুল্কারোপের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।

যদিও এ শুল্কারোপ থেকে শিগগিরই মুক্তি পাচ্ছে না বাংলাদেশ। কারণ অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্কারোপের মেয়াদ বাড়ানোর জন্য এরই মধ্যে সুপারিশ করেছে ভারতীয় জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশন (আইজেএমএ)। সংগঠনটি দাবি করছে, পাটপণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশ সরকারের দেয়া ভর্তুকি ভারতের ব্যবসায়ীদের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ভারতের সংবাদ মাধ্যম ‘দ্য হিন্দু’র সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। ‘বাংলাদেশ সাবসিডিস ক্রিপলিং জুট ইন্ডাস্ট্রিজ, সেস ইন্ডিয়ান জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশন’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্কারোপের পরও ভারতে বাংলাদেশের পাটপণ্য রপ্তানি বাড়ছে। আইজেএমএ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, বাংলাদেশের পাটপণ্য রপ্তানিতে অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক বহাল থাকবে কি না বিষয়টি ভারত সরকার বিবেচনা করছে। তবে সে সময় (২০১৭ সালে) যদি ভারত সরকার বাংলাদেশের পাটপণ্য রপ্তানির ওপর অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্কারোপ না করত তাহলে দেশটির পাটশিল্প এতদিনে ধ্বংস হয়ে যেত।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আইজেএমএ মনে করছেÑবাংলাদেশের পাটপণ্যের জন্য বাজার উš§ুক্ত করে (শুল্ক তুলে) দিলে ভারতের পাট শিল্পের ওপর কী প্রভাব পড়বে, নতুন পণ্য ও নতুন বাজার তৈরিতে কী প্রভাব পড়বে ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করছে ভারত সরকার। তবে এক্ষেত্রে সব চেষ্টাই বন্ধ করে দিয়েছে পাটপণ্যে বাংলাদেশ সরকারের উচ্চ ভর্তুকি। বাংলাদেশ যে কোনো মূল্যে শুধু নিজেদের পাট শিল্প বিকাশে গুরুত্ব দিচ্ছে। এতে প্রতিবেশী দেশ কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হলো তা বিবেচনা করছে না দেশটি। এছাড়া বাংলাদেশ পাটের সুতা (ইয়ার্ন), বস্তা, হেসিয়ান (চট) ফেব্রিক রপ্তানিতে নতুন সহায়তা দিচ্ছে, যা দেশটির রপ্তানিতে বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে।

যদিও গত মার্চে বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য সচিব পর্যায়ে বৈঠকে পাটপণ্যে অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক তুলে দেয়ার জন্য অনুরোধ করে বাংলাদেশ। এর আগেও একাধিক বৈঠকে এ প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা হয়। তবে ভারতের কাছ থেকে কখনোই এ বিষয়ে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়নি।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের পাটপণ্যে অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্কারোপের জন্য ২০১৫ সালেই ভারতের এন্টি-ডাম্পিং অ্যান্ড অ্যালাইড ডিউটিজে (ডিজিএডি) আবেদন করে আইজেএমএ। পরে এ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিক শুনানিও অনুষ্ঠিত হয়। এর ভিত্তিতেই বাংলাদেশের পাটপণ্য রপ্তানিতে অ্যান্টি-ডাম্পিং  শুল্ক আরোপ করেছিল ভারত।

তিন ধরনের পাটপণ্য রপ্তানিতে পাঁচ বছরের জন্য অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক আরোপ করা হয় সে সময়। এগুলো হলো হেসিয়ান (চট) ফেব্রিক, জুট ইয়ার্ন (সুতা) ও পাটের বস্তা। শুল্কের অর্থ ভারতীয় মুদ্রায় রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানকে পরিশোধ করতে হয়। এতে ভারতে পাটপণ্য রপ্তানি ব্যাহত হয়।

এদিকে ভারতীয় শিল্প মালিকদের অনুরোধে ডিজিটিআর বাংলাদেশ থেকে রপ্তানিকৃত পাটপণ্যের ওপর অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্কারোপের মেয়াদ আরও পাঁচ বছর বৃদ্ধির জন্য সানসেট রিভিউ শুরু করেছে। রিভিউয়ের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা ভারতের নির্ধারিত প্রশ্নের জবাব পাঠিয়েছে। এছাড়া বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে আন্তঃমন্ত্রণালয় প্রতিনিধিদলের মৌখিক শুনানিতেও অংশগ্রহণ করেছে। একই সঙ্গে পোস্ট হেয়ারিং স্টেটমেন্ট ও রিজয়েন্ডার দাখিল করা হয়েছে। ডিজিটিআর শিগগিরই তদন্তের ফলাফল প্রকাশ করবে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ জুট গুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান মো. শফিকুল ইসলাম শেয়ার বিজকে বলেন, অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক আরোপের পর গত পাঁচ বছরে দেশের পাটপণ্য রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যদিও তা প্রত্যাহারের জন্য ভারতের সঙ্গে অনেক আলোচনা হয়েছে। তবে এর কোনো সুফল পাওয়া যায়নি। এতে বর্তমানে এ খাত খুবই খারাপ অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তাই অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক প্রত্যাহারের বিষয়ে সরকারকে আরও জোরালো ভ‚মিকা গ্রহণ করা উচিত।

নিয়মানুসারে, কোনো পণ্যে ডাম্পিং সংক্রান্ত অভিযোগের বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থার (ডবিøউটিও) অ্যান্টি-ডাম্পিং এগ্রিমেন্ট (১৯৯৪) অনুসরণ করতে হয়। বাংলাদেশ ও ভারত উভয়ই এই চুক্তির স্বাক্ষরকারী। ওই চুক্তি অসুযায়ী, ডাম্পিংয়ের অভিযোগ তদন্তের জন্য সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া রয়েছে। সে অনুযায়ী, অভিযুক্ত দেশ সত্যিই কমদামে পণ্য পাঠাচ্ছে কি না তা প্রমাণের পাশাপাশি আমদানিকারক দেশের স্থানীয় শিল্পের ওপর এর প্রভাব কী তা স্পষ্ট হতে হয়। তদন্তাধীন সময়ে আমদানিকারক দেশের স্থানীয় শিল্পের ক্ষতির প্রমাণ পাওয়া গেলেও তদন্তের অপর একটি ধাপ বাকি থাকে। তা হলোÑকম দামে রপ্তানির সঙ্গে স্থানীয় পণ্যের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয়টির সরাসরি সংযোগ প্রমাণিত হতে হবে।

নিয়মানুযায়ী তদন্তের উদ্যোগ নেয় ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। অত্যন্ত জটিল ওই তদন্ত প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে একটি দীর্ঘ প্রশ্নমালা পূরণ করতে হয় বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ওই বিষয়ে একটি প্রশ্নমালা বাংলাদেশি জুট স্পিনার্স, জুট মিলস, জুট গুডস এক্সপোর্টার্সসহ ১৩০টি প্রতিষ্ঠানকে পাঠায়। এ সময় বাংলাদেশে বন্ধ হয়ে যাওয়া কোম্পানিকেও ওই প্রশ্নপত্র পাঠানো হয়েছে। অনেক কোম্পানিকে পাঠানো হয়েছে যারা ভারতে পণ্য রপ্তানি করেই না।

অন্যদিকে, বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের এ-সংক্রান্ত প্রশ্নপত্র পাঠানো হলেও তারা এর যথাযথ জবাব দিতে পারেনি। এছাড়া এ-সংক্রান্ত জবাব দেয়ার জন্য নিয়মানুসারে আইনজীবী নিযুক্ত করার কথা থাকলেও বিষয়টিকে সে সময় গুরুত্ব দেননি বাংলাদেশের পাটরপ্তানিকারকরা। আর যেসব তথ্য চাওয়া হয়েছিল তা বড় একটা বইয়ের সমান। কোন দেশে কত পরিমাণ রপ্তানি করা হয়, কী ধরনের পণ্য রপ্তানি করা হয়, উৎপাদন খরচ কত, ডলারের মূল্য কত, স্থানীয় বাজারে বিক্রির পরিমাণ কতÑএসব তথ্যের ফিরিস্তি চাওয়া হয়। এগুলোর সঠিক জবাব সে সময় দেয়া হয়নি।

এ প্রসঙ্গে একজন রপ্তানিকারক শেয়ার বিজকে জানান, ‘অনেক কনফিডেন্সিয়াল বিষয়ও জানতে চাওয়া হয়েছে কিন্তু, এত তথ্য আমরা ভারতকে দেব কেন?’ এদিকে রপ্তানিকারকদের কাছে তথ্য চাওয়া হলেও এ-সংক্রান্ত অভিযোগে ভারতীয় পাটকলের মালিকরা কী বলেছেন তার ‘নন-কনফিডেন্সিয়াল’ অংশ স্পষ্ট করা হয়নি। ফলে, সব রপ্তানিকারক ওই প্রশ্নপত্রের জবাব দিতে পারেনি। মাত্র ২৬টি প্রতিষ্ঠান প্রশ্নপত্রের জবাব দিয়েছিল।

জানা গেছে, বাংলাদেশের অভিযুক্ত রপ্তানিকারকের দেয়া ওই জবাবের পর ভারতীয় কর্তৃপক্ষের দুই সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে আসে। তারা যে ২৬টি প্রতিষ্ঠান তথ্য দিয়েছিল তাদের মধ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে। দুটি পাটকলও পরিদর্শন করা হয়। ওই সফরের সময় তারা বাংলাদেশ জুট গুডস অ্যাসোসিয়েশনের কার্যালয়ে দেশের বিভিন্ন রপ্তানিকারকদের সঙ্গে বৈঠকও করেন। তখন পর্যবেক্ষক হিসেবে বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন। পরিদর্শন শেষে এ সংক্রান্ত অভিযোগে শুনানি অনুষ্ঠিত হয় দিল্লিতে। তখনই বিষয়টি প্রায় নিশ্চিত হয়ে যায় যে বাংলাদেশের ওপর অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক বসানো হচ্ছে।

বাংলাদেশ জুট গুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, গতবারের মতোই একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করছে ভারত। আর বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরাও সব প্রশ্নের উত্তর দেয়নি। কারণ কিছু প্রশ্নের উত্তর দেয়া মানে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারা। ফলে এবারও একই ধরনের শুল্কারোপের ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ।