Print Date & Time : 18 June 2025 Wednesday 7:34 pm

বাংলাদেশের কয়লার দাম বিশ্বে সবচেয়ে বেশি!

ইসমাইল আলী: বড়পুকুরিয়া খনির কয়লার দাম প্রতি মেট্রিক টন ১৭৬ ডলার। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কয়লার দামের মধ্যে তা সর্বোচ্চ। এমনকি কয়লার আন্তর্জাতিক বাজার ইন্দোনেশিয়া কোল প্রাইস ইনডেক্স বা নিউক্যাসেল কোল প্রাইস ইনডেক্সেও কয়লার দাম বাংলাদেশের তুলনায় ২০-২৫ শতাংশ কম। তাই বড়পুকুরিয়ার খনির কয়লার দাম কমানোর দাবি জানিয়েছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)।

সম্প্রতি পিডিবি থেকে এ-সংক্রান্ত চিঠি দেয়া হয় বিদ্যুৎ বিভাগে। এতে বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানির কয়লার দাম আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কমানো বা সমন্বয়ের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিবকে অনুরোধ করতে বলা হয়।

সূত্রমতে, বড়পুকুরিয়া খনির কয়লা বিদ্যুৎ উৎপাদনে ২০০৬ সাল থেকে ব্যবহার করছে পিডিবি। সে সময় প্রতি মেট্রিক টন কয়লার দাম ছিল ৬০ ডলার। পরে তা চার দফা বাড়িয়ে ১০ বছরের মধ্যে করা হয় ১৩০ ডলার। এরপর ছয় বছর পরে তা বাড়ানো হয়। তবে চলতি বছর জানুয়ারিতে বড়পুকুরিয়ার কয়লার দাম বাড়ানো হলেও বর্ধিত ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে কার্যকর করে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। এ দাম নিয়েই আপত্তি জানিয়ে সম্প্রতি চিঠি দিয়েছে পিডিবি।

চিঠিতে ১৪ জুন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কয়লার দাম তুলে ধরে পিডিবি। সংস্থাটির তথ্যমতে, সে সময় বিশ্বে কয়লার দাম সবচেয়ে কম ছিল চীন ও দক্ষিণ কোরিয়ায়। দেশ দুইটিতে কয়লার দাম ছিল প্রতি মেট্রিক টন ১০১ দশমিক ৬০ ডলার। প্রতিবেশী দেশ ভারতে এ দাম ১১০ দশমিক ৭০ ডলার। রাশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক ও ভিয়েতনামে প্রতি মেট্রিক টন কয়লার দাম ১১২ দশমিক ৭০ ডলার এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় ১৪০ দশমিক ৮০ ডলার। আর বাংলাদেশে বড়পুকুরিয়া খনির কয়লার দাম ১৭৬ ডলার। অর্থাৎ বড়পুকুরিয়ার কয়লার দাম অন্যান্য দেশের চেয়ে ২৬ থেকে ৭২ শতাংশ পর্যন্ত বেশি।

এ অবস্থায় বড়পুকুরিয়ার কয়লার দাম কমানোর বিষয়ে চিঠিতে বলা হয়, গত ৫ জানুয়ারি জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানির কয়লার দাম বৃদ্ধি করে। তবে তা ২০২২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর করা হয়। এ-সংক্রান্ত আদেশে কয়লার মূল্য পুনর্নির্ধারণের শর্ত অনুযায়ী অনুচ্ছেদ-ঙ-তে বলা হয়েছে, ‘ষাণ¥াষিক ভিত্তিতে সংশ্লিষ্টগণকে নিয়ে সভা করে মূল্য সমন্বয়ের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।’

পিডিবি আরও জানায়, প্রতি মেট্রিক টন কয়লার দাম ১৩০ ডলার থেকে ১৭৬ ডলারে বৃদ্ধি করায় এবং ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশি টাকায় বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি খরচ ৭৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে পিডিবি বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়ের চেয়ে গড়ে কম মূল্যে বিক্রি করায় বিপুল আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। ফলে সরকারের ভর্তুকির পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পাবে, যা না পেলে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদনে জটিলতা ও জন-অসন্তোষ সৃষ্টির কারণ হতে পারে। এ কারণে বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানির কয়লার দাম কমানো উচিত।

জানতে চাইলে পিডিবির একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানির কয়লার দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবে কিছু অযৌক্তিক দাবি ছিল। যেমন, খনিটির উত্তর দিকে আগামীতে কয়লা উত্তোলন করা হবে। এজন্য খনির উত্তরাংশ বর্ধিত করতে ৩০০ একর জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। ওই জমি অধিগ্রহণে এক হাজার ২০০ কোটি টাকা লাগবে। এছাড়া চলতি অর্থবছর ১৫ দশমিক ৬৫ একর জমি খনির মধ্যভাগের জন্য অধিগ্রহণ করতে হবে। এজন্য ১১৩ কোটি ৯৫ লাখ টাকা ব্যয় হবে। এ ব্যয়কে কয়লার দামের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পিডিবির পক্ষে থেকে এ নিয়ে আপত্তি জানানো হয়েছিল।

তারা আরও বলেন, জামালগঞ্জ কয়লা খনি ও আলিহাট লৌহ আকরিক খনি প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই এবং দিঘীপাড়াসহ অন্যান্য কয়লাক্ষেত্র উন্নয়নের জন্য অর্থের প্রয়োজন। এ খাতে ৬০০ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে, যা প্রতি বছর সমানভাবে বরাদ্দ ধরা হয়েছে সম্ভাব্য বাজেটে। এ দামও কয়লার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ নিয়েও আপত্তি তোলা হয়েছিল। তবে পিডিবির কোনো আপত্তিকেই আমলে না নিয়ে এককভাবে বড়পুকুরিয়ার কয়লার দাম নির্ধারণ করা হয়।

এদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দাম এখন নি¤œমুখী। গত ডিসেম্বরে তা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। ওই সময় প্রতি মেট্রিক টন কয়লার দাম ৪০০ ডলারের বেশি ছিল। তবে বর্তমানে নিউক্যাসেল কোল ইনডেক্স অনুযায়ী বর্তমানে প্রতি মেট্রিক টন কয়লার দাম ১৪১.৮০ ডলার। আর ইন্দোনেশিয়া কোল ইনডেক্স অনুযায়ী বর্তমানে সবচেয়ে ভালো মানের কয়লার দাম প্রতি মেট্রিক টন ১২০.৫২ ডলার। অর্থাৎ বাংলাদেশের কয়লার চেয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম ২৪ থেকে ৪৬ শতাংশ কম।

এ প্রসঙ্গে পিডিবির কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে শেয়ার বিজকে বলেন, বড়পুকুরিয়া খনি থেকে নিয়মিত কয়লা পাওয়া যায় না। বছরের তিন থেকে ছয় মাস পর্যন্ত খনি পুরোপুরি বা আংশিক বন্ধ থাকে। এতে কয়লা সংকটে বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রটির এক বা একাধিক ইউনিট বন্ধ রাখা হয়। ফলে বাধ্য হয়েই আমদানিকৃত কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পরিচালনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। তবে এক্ষেত্রে কয়লা পরিবহন অন্যতম বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

তারা জানান, সাধারণত কয়লা পরিবহনের সুবিধার্থে নদী বা সমুদ্রবন্দরের কাছাকাছি এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়। তবে বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রটি সমুদ্রবন্দর থেকে অনেক দূরে। সড়কপথে কয়লা পরিবহন করে তা দিয়ে কেন্দ্রটি পরিচালনা সম্ভব নয়। আর তা করলেও পরিবহন ব্যয় অনেক বেশি পড়বে। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে। তাই পরে এ পরিকল্পনা বাতিল করা হয়। এতেই সুযোগ পেয়ে বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি ইচ্ছামতো দাম পিডিবির ওপর চাপিয়ে দিয়েছে।

প্রসঙ্গত, বড়পুকুরিয়া কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে তিনটি ইউনিটের উৎপাদন সক্ষমতা ৫২৫ মেগাওয়াট। এজন্য প্রতিদিন কয়লার প্রয়োজন সাড়ে পাঁচ হাজার মেট্রিক টন। কিন্তু খনিতে বর্তমানে দৈনিক উৎপাদিত হয় দুই থেকে তিন হাজার মেট্রিক টন। এছাড়া খনির যে স্তর থেকে বর্তমানে কয়লা উত্তোলন করা হচ্ছে, সেখান থেকে প্রতিদিন তিন হাজার মেট্রিক টনের বেশি কয়লা পাওয়া সম্ভব নয়। এতে প্রতিদিন ঘাটতি থাকে আড়াই থেকে সাড়ে তিন হাজার মেট্রিক টন। এর মধ্যে আবার বছরে শিফট পরিবর্তনের জন্য খনির কয়লা উত্তোলন তিন মাস বন্ধ থাকে। এসব কারণে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি এক বা একাধিক ইউনিট প্রায়ই বন্ধ থাকে।