‘বাংলাদেশের কার্ডিয়াক সার্জারি বিশ্বমানের’

ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরী বাংলাদেশের নারী কার্ডিয়াক সার্জনদের অগ্রদূত। রেজিস্ট্রার (কার্ডিয়াক সার্জন) হিসেবে কর্মরত জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে। শেয়ার বিজের সঙ্গে একান্তে কথা বলেছেন নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে। পরামর্শ দিয়েছেন হৃদরোগের নানা বিষয়ে। তার চিকিৎসক হয়ে ওঠার গল্প ও হৃদরোগ নিয়ে নানা পরামর্শ জানার চেষ্টা করেছেন পারভীন লুনা

নারীদের অনেকে গাইনি বিষয়ে পড়তে চান, কিন্তু আপনি কার্ডিয়াক সার্জন হলেন কেন?

ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরী: একটি বিষয় পরিষ্কার জানিয়ে রাখি পুরুষ পারলে নারীও পারবে। আমি এটা বিশ্বাস করি। আমরা দুই বোন ছিলাম। সবাই বলত, হয়েছ তো মেয়ে, বাবা মরে গেলে তো লাশটাও কাঁধে নিতে পারবে না। এসব কথা খুব আহত করত। ভাবতাম, এমন কিছু করব যাতে লাশ কাঁধে নিতে না পারি, তবে যেন বাবা জীবিত থাকতেই তার মাথা উঁচু করতে পারি। মেয়ে হয়ে জন্মেছি বলে কেউ যেন করুণার চোখে না দেখে সব সময় এটাই চেয়েছি।
আমি দেশকে খুব ভালোবাসি। দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য সব সময় কিছু করতে চাইতাম। এ ধারণা থেকেও চিকিৎসক হওয়ার একটি ইচ্ছা তৈরি হয়।
পাস করার সময় মনে হয়েছে গাইনি বিষয়ে পড়ব। এরপর মত পাল্টাই। গাইনি পড়ার মধ্যে তেমন কোনো চ্যালেঞ্জ নেই। আমি এমন কিছু করতে চাইতাম, যেটি অনেক চ্যালেঞ্জিং। আমার আগে একজন নারী এ বিষয়ে পাস করেছিলেন কিন্তু ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারেননি। তাই অনেকে ভেবেই নিয়েছিলেন, মেয়েদের দ্বারা এ বিষয়ে কাজ করা সম্ভব নয়। এতে আমার জেদ চেপে যায়। আর হার্ট নিয়ে পড়তে আমার ভালো লাগত। তাই কার্ডিয়াক সার্জারিতে পড়ালেখা শুরু করি।ছয় বছর কার্ডিয়াক সার্জারি বিষয়ে পড়তে গিয়ে মাঝেমধ্যে অবসাদ ঘিরে ধরেছে আমাকে। তবে এগিয়ে গেছি।

কার্ডিয়াক সার্জারিতে কাজ করতে কেমন লাগছে?
সাবরিনা আরিফ: কাজ করতে ভীষণ ভালো লাগে। যখন অ্যাপ্রোন পরি, যখন অপারেশন থিয়েটারে ঢুকি, হার্ট কাটি, তখন আমার মাথায় আর কিছু থাকে না। আমার মধ্যে কেবল কাজ থাকে। অন্য জগতের মানুষ হয়ে যাই। একজন নারীকে যোগ্য হয়ে উচ্চপদে যেতে হলে পুরুষের চেয়ে দ্বিগুণ পরিশ্রম করতে হয়। আমি মনে করি, কোনো কিছুতে একমাত্র মেয়ে হওয়া ভালো নয়। এ খাতে আরও অনেক মেয়ের আসা উচিত। নয়তো রোগীরা নারী চিকিৎসকের ওপর আস্থা রাখতে পারবেন না।

পেশাটি কতটা চ্যালেঞ্জিং?
সাবরিনা আরিফ: চ্যালেঞ্জিং তো বটেই। কারণ, অনেক সময় আমাদের দীর্ঘক্ষণ অপারেশন থিয়েটারে থাকতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে রোগীর অবস্থা কি হয়-না হয়, এ বিষয় মাথায় ঘুরপাক খায়। সেক্ষেত্রে বলব এটি এক ধরনের চ্যালেঞ্জ। এছাড়া এ সময় (অপারেশন) পরিবারের সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকে।

ইদানীং চিকিৎসক ও রোগীর মধ্যে আস্থার সংকট চোখে পড়ছে…
সাবরিনা আরিফ: আসলে আমাদের দেশে সমস্যা হচ্ছে, চিকিৎসকরা রোগীর সঙ্গে বা রোগীর স্বজনদের সঙ্গে রোগ নিয়ে বা রোগীর অবস্থা নিয়ে কোনো আলাপ করেন না। অপারেশনের আগে আমরা (চিকিৎসকরা) তাদের সঙ্গে কোনো ধরনের কাউন্সেলিং করি না। রোগীর রোগটা কী? কেন অপারেশন করতে হবে বা অপারেশন করলে কী হবে? এসব বিষয়ে তাদের সঙ্গে অনেক চিকিৎসক আলাপ করেন না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের মতামত নিই না বা অপারেশনের পর তাদের কি সমস্যা হতে পারে সেটাও তাদের জানিয়ে রাখি না। এটা রোগীর সঙ্গে চিকিৎসকের সম্পর্ক নষ্টের পেছনে বড় কারণ বলে মনে করি। আমার মনে হয়, চিকিৎসকদের নিজস্ব সেইফটির জন্য রোগীদের সঙ্গে কাউন্সেলিং করা উচিত। কাউন্সেলিংটা বাড়াতে হবে।

দেশে কার্ডিয়াক সার্জারির মান কেমন? এ ধরনের অপারেশনে খরচ কেমন?
সাবরিনা আরিফ: আমাদের দেশের কার্ডিয়াক সার্জারির মান এখন বিশ্বমানের। অনেক রোগীই আগে বিদেশে চিকিৎসার জন্য যেতেন। এখন অনেকে আমাদের দেশেই থাকছেন। অপারেশনের পর ফলোআপটা জরুরি। আর সরকারি হাসপাতালে খরচ অত্যন্ত কম। বেসরকারি হাসপাতালের মান অনুযায়ী খরচ তুলনামূলক বেশি।

এ ধরনের অপারেশনের সফলতা কেমন? ভালো হতে কত সময় লাগে?
সাবরিনা আরিফ: এ ধরনের অপারেশনে রোগী মৃত্যুর হার সারা বিশ্বে পাঁচ শতাংশ। আমাদের দেশেও তা-ই। আর সাকসেস রেটও সমান। রোগী ভালো হতে কত সময় লাগে সেটা নির্ভর করে রোগীর অবস্থার ওপর। একেক রোগীর একেক ধরনের সমস্যা।

হৃদরোগ প্রতিরোধে করণীয়…
সাবরিনা আরিফ: হৃদরোগ তিন ধরনের। যেমন হার্টের ভাল্বের সমস্যা, হার্টের ব্লক ও শিশুর জন্মগত হার্টের সমস্যা। এক্ষেত্রে গর্ভবতী মাকে টিকা নিশ্চিতকরণের পাশাপাশি তার পুষ্টি নিশ্চিত করা জরুরি। এছাড়া আত্মীয়দের মধ্যে বিয়ে না করা উচিত। আমাদের দেশে ৯০ ভাগ ভাল্বের সমস্যা হয় বাতজ্বর থেকে। এক্ষেত্রে বাতজ্বরটা শনাক্ত করা ও আক্রান্ত রোগী যেন সঠিকভাবে চিকিৎসা নিতে পারেন সে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। ব্লক সমস্যার ক্ষেত্রে আমাদের খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। ধূমপান করা যাবে না। এছাড়া যতদূর সম্ভব, দুশ্চিন্তামুক্ত জীবনযাপন করা উচিত।

হৃদরোগীদের বেশিরভাগই বিদেশে চিকিৎসা নিতে যান কেন?
সাবরিনা আরিফ: আসলে সব মানুষেরই সামর্থ্য অনুযায়ী সেবা নেওয়ার অধিকার রয়েছে। সবেচেয়ে ভালো চিকিৎসা নেওয়ার অধিকার রয়েছে। তবে আমরা বলতে পারি, দেশেই এখন বিশ্বমানের কার্ডিয়াক সার্জারি হচ্ছে। আমরা আশা করি, আগামী পাঁচ বছর পর আর কোনো কার্ডিয়াক রোগী চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যাবেন না।

সেবার মান বাড়াতে করণীয় কী?
সাবরিনা আরিফ: আমাদের স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। অনেক ভালো ওষুধের সরবরাহও রয়েছে। এছাড়া হাসপাতালে ভাল্বের সরবরাহ রয়েছে। রোগীর অপারেশন খরচ এখানে খুবই কম। তবে সরকারকে যা করতে হবে, তা হচ্ছে হাসপাতালে বেডের সংখ্যা বাড়াতে হবে। এখনও বেডের সংখ্যা অত্যন্ত কম। হাসপাতালের পরিসর বাড়ানোর পাশাপাশি অপারেশন থিয়েটারের সংখ্যাও বাড়াতে হবে।

দেশে পর্যাপ্ত কার্ডিয়াক সার্জন আছেন কি না…
সাবরিনা আরিফ: যখন হাসপাতালে সুযোগ তৈরি হবে, তখন অটোমেটিক্যালি সার্জন পোস্ট তৈরি হবে। এজন্য হাসপাতালের অবকাঠামো ঠিক রাখতে হবে।

ছোটবেলায় কী হতে চেয়েছিলেন বা কী স্বপ্ন দেখতেন নিজেকে নিয়ে?
সাবরিনা আরিফ: ছোটবেলায় ইচ্ছা ছিল অভিনেত্রী বা শিল্পী হব। মায়ের ইচ্ছা ছিল আমাকে চিকিৎসক বানাবেন। তার চেষ্টার কারণেই সবশেষে চিকিৎসক হয়েছি।

ছোটবেলার কোনো মজার ঘটনা…
সাবরিনা আরিফ: ছোটবেলা কেটেছে হল্যান্ডে। আমার যখন দুই মাস বয়স, তখন আমার পরিবার নেদারল্যান্ডসে চলে যায়। সেখানে অ্যাম্বেসির মাধ্যমে এসএসসি পরীক্ষা দিই। এরপর আমার পুরো পরিবার আমেরিকায় স্থায়ী হয়। তবে আমি দেশে চলে আসি। বাবা সরকারি চাকরি করতেন। তিনি সচিব ছিলেন। খুব কড়া মেজাজের ছিলেন। আমাদের কখনও গান শুনতে দিতেন না, টিভি দেখতে দিতেন না। ভাবতেন, গান শুনলে মনে প্রেম ভাব তৈরি হবে! সারাদিন কেবল পড়া পড়া আর পড়া। আমার ছোটবেলার কোনো মজার ঘটনা নেই। অনেকে শৈশবে ফিরতে চান; কিন্তু আমি চাই না।
তবে ছোটবেলায় নাচ শিখেছি। বাবাকে লুকিয়ে, মায়ের সহযোগিতায়। মা লুকিয়ে আমার জন্য নাচের অ্যারেঞ্জ করতেন। এখন মাঝেমধ্যে চিকিৎসকদের অনুষ্ঠানে নৃত্য পরিবেশ করি।
এখানে মেডিক্যাল কলেজে পড়ার সুযোগ পাই। সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হই। এরপর প্রশিক্ষণ নিই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে। এমএস করেছি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
নায়িকাও হতে চেয়েছিলাম এক সময়! তবে বাবার কড়া শাসনের কারণে আর সেটি হয়ে ওঠেনি। নায়িকা হওয়ার জন্য প্রস্তাবও পেয়েছিলাম। লুকিয়ে অভিনয়ের রিহার্সেলে যেতাম। তবে যেদিন ফাইনাল শুটিং হবে, সেদিন বাবা বুঝে গেলেন সবকিছু। তাই আমার আর অভিনয় করা হলো না।

আপনার প্রথম পোস্টিং কোথায় ছিল এবং কেমন লেগেছে সেখানে?
সাবরিনা আরিফ: চাকরি পাওয়ার পর আমার প্রথম পোস্টিং হয় দিনাজপুরের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে। সেটি এমন এক জায়গা ছিল, যেখানে কাটাকুটি করার মতো কোনো যন্ত্র ছিল। কোনো রকমে কিছু ওষুধ আসত। সেখানে থেকে আমার মনে হয়েছে এসব জায়গা যদি উন্নত করা যায়, তাহলে অনেক চিকিৎসক গিয়ে কাজ করবেন। তবে তেমন কিছু নেই বলেই কাজ করার সুযোগ সেসব জায়গায় কম। এরপর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বদলি হয়ে আসি। এখন কাজ করছি জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে।
বিশ্বে নারী কার্ডিয়াক সার্জনের সংখ্যা কম। তাই যেখানেই গিয়েছি, অনেক সমাদর পেয়েছি। বাংলাদেশের মতো একটি দেশে নারী কার্ডিয়াক সার্জন রয়েছেন এটি ভেবে অনেকে অবাক হয়েছেন।
আমি এতদিন কেবল দৌড়ে চলেছি একটি ভালো প্ল্যাটফর্মে কাজ করার জন্য। মূল কাজ শুরু হয়েছে। যেতে হবে বহু দূর। আরও অনেক কাজ করতে হবে।
এ পর্যন্ত আসতে পুরুষের চেয়ে অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হয়েছে। অনেক বেশি সতর্কতার সঙ্গে কাজ করতে হয় সব সময়। একজন মানুষ নিজের হার্টটি একজন নারীকে কাটতে দিয়ে দেবেন ব্যাপারটি সহজ নয়। এজন্য নিজেকে যোগ্যতম করতে হয়েছে। এখন পুরো দেশের মানুষের আস্থা অর্জন করতে হবে। আমি জীবনে যা চেয়েছি, তা-ই পেয়েছি। এখন মানুষের জন্য আরও কাজ করতে চাই।

রোগীদের নিয়ে কোনো ঘটনা…
সাবরিনা আরিফ: রোগীদের ভালোবাসাই আমার পাওয়া। একবার একজন দরিদ্র রোগীকে বিনা পয়সায় চিকিৎসা করেছিলাম। কিছুদিন পর তিনি রিকশা চালিয়ে আমার জন্য একটি শাড়ি এনেছিলেন। শাড়িটি আমি ফিরিয়ে দিতে পারিনি। ভীষণ আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলাম সেদিন। রোগীরা যখন দোয়া করেন, ভালোবাসেন, তখন একে আমার বড় পাওয়া বলে মনে হয়। এমনও হয়েছে, সার্জারির পর অনেক দূর থেকে রোগী আমার কাছে এসেছেন কেবল সেলাই কাটার জন্য। এটা অনেক বড় কিছু বলে মনে করি।
অনেক রোগীই কন্যাসন্তানের নাম আমার নামে রেখেছেন। এগুলো অনেক বড় পাওয়া বলে মনে হয়। এ দোয়াটা অনেক বড় কিছু।

পরিবার থেকে কেমন সহযোগিতা পান?
সাবরিনা আরিফ: পরিবারের লোকদের সহযোগিতায় এগিয়ে যাচ্ছি। আমার কাজের ব্যাপারে পরিবারের লোকেরা অনেক সহযোগিতা করে। বিশেষ করে আমার স্বামী এ বিষয়ে বেশ আন্তরিক। তিনি সব সময় আমাকে উৎসাহ দেন। আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ।

এ পেশায় যারা ক্যারিয়ার গড়তে ইচ্ছুক, তাদের উদ্দেশে কিছু বলুন…
সাবরিনা আরিফ: যারা এ পেশায় আসতে চান, তাদের উদ্দেশে বলব: কার্ডিয়াক সার্জন হওয়ার জন্য বেশি সময় দিতে হয়। কেননা, একটি অস্ত্রোপচারের পর বলা যায় না রোগীটির অবস্থা কেমন হবে? ২৪ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণের মধ্যে রোগীকে রাখতে হয়। তাই যারা অনেক পরিশ্রম ও শ্রম দিতে পারবেন, তাদেরই কার্ডিয়াক সার্জারি পেশায় আসা উচিত।

আপনার স্বপ্ন…
সাবরিনা আরিফ: স্বপ্ন দেখি অনেক। বাংলাদেশে এখনও হার্ট ট্রান্সপ্লানটেশনের ব্যবস্থা চালু হয়নি। এটি চালু করার চেষ্টা চলছে। এ নিয়ে কাজ করার চিন্তা চলছে। এর সঙ্গে যুক্ত হতে চাই।
আমি চাই গরিব রোগীদের সেবা করতে। তাই সব সময় সরকারি হাসপাতালে কাজ করতে চাই। বেসরকারি হাসপাতালে যেতে চাই না। সেখানে সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করার সুযোগ কম। দেশের মানুষের জন্য কাজ করব এটিই আমার স্বপ্ন, এটিই আমার আশা।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০