রোহান রাজিব: দেশের বৈদেশিক ঋণ গত জুন শেষে বেড়ে প্রায় ১০৪ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি পৌঁছেছে। ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানো শেখ হাসিনার সরকার গত সাড়ে ১৫ বছরে দেদারসে এসব ঋণ নিয়েছে। এই সাড়ে ১৫ বছরে শেখ হাসিনার সরকার প্রায় ৮১ বিলিয়ন ডলার ঋণ করেছেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত জুন পর্যন্ত বিদেশি ঋণের প্রতিবেদন গতকাল আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেছে। তাতে বৈদেশিক মোট ঋণের স্থিতি দেখানো হয়েছে ১০ হাজার ৩৭৯ কোটি ডলার বা ১০৩ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন, যা দেশীয় মুদ্রায় ১২ লাখ ৪৫ হাজার ৪৮০ কোটি টাকার সমান (প্রতি ডলার ১২০ টাকা ধরে)। এর মধ্যে সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ৮৩ দশমিক ২১৫ বিলিয়ন ডলার। আর দেশের বেসরকারি খাতের বিদেশি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ২০ দশমিক ৫৭৪ বিলিয়ন ডলার। অথচ বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার বিদায় নেয়ার পর (২০০৬ সাল শেষে) বাংলাদেশের বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ১৯ বিলিয়ন ডলারের কিছু কম।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছরে তা সোয়া দুই বিলিয়ন ডলারের মতো বাড়ে। এতে ২০০৮ সাল শেষে তা দাঁড়ায় ২১ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। তবে আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে তা বেড়ে ৮২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে।বিশ্লেষকদের মতে, সাবেক সরকারের যথাযথ ঋণ ব্যবস্থাপনা না থাকায় দেশি উৎস থেকে বেশি পরিমাণে ঋণ নেয়া হয়েছে। যদিও বৈদেশিক মুদ্রায় বিদেশি ঋণ নেয়াকে সব সময় স্বাগত জানান অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা। গত ১৫ বছরে অনেক বিদেশি ঋণও নেয়া
হয়েছে। তবে এসব ঋণের বেশিরভাগই নেয়া হয়েছে দর-কষাকষি ও বাছবিচারহীনভাবে, যা সরকারের দায়দেনা পরিস্থিতিতে চাপ বাড়িয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০০৮ সাল শেষে সরকারের বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ২১ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলার। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি দায়িত্ব নেয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। পরের পাঁচ বছরে সরকারের বৈদেশিক ঋণ বৃদ্ধি পায় ৬ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলার। এতে ২০১৩ সাল শেষে সরকারের বিদেশি ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় ২৭ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলার।
ওই পাঁচ বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০০৯ সালে সরকারের বিদেশি ঋণ ১ দশমিক ১২ বিলিয়ন বাড়লেও ২০১০ সালে তা প্রায় ৬৭৫ মিলিয়ন ডলার হ্রাস পায়। তবে পরের বছর তা প্রায় ৭২৯ মিলিয়ন ডলার বাড়ে। যদিও ২০১২ সালে বাড়ে প্রায় ১ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন এবং ২০১৩ সালে প্রায় ৩ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডলার।
২০১৪ সালে আবারও ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ সরকার। এর পরের পাঁচ বছরে (২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল) দ্রুত বৈদেশিক ঋণ বৃদ্ধি পায়। ওই পাঁচ বছরে সরকারের বৈদেশিক ঋণ বৃদ্ধি পায় ১৬ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলার বা ৬০ দশমিক ৬৮ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৮ সাল শেষে সরকারের বিদেশি ঋণ স্থিতি দাঁড়ায় ৪৪ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলার। ওই পাঁচ বছরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৪ সালেই বিদেশি ঋণ বৃদ্ধি পায় ২ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার। তবে পরের বছর তা মাত্র ৩১ মিলিয়ন ডলার বাড়ে। ২০১৬ সালে বিদেশি ঋণ বাড়ে ১ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলার, ২০১৭ সালে রেকর্ড ৬ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন ও ২০১৮ সালে ৫ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার।
এদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের টানা তৃতীয় মেয়াদের পাঁচ বছরে (২০১৯-২০২৩) বৈদেশিক ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে সবচেয়ে বেশি। এ সময় বিদেশি ঋণ বেড়েছে ৩৫ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৭৯ শতাংশ। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে বাংলাদেশ সরকারের বৈদেশিক ঋণের স্থিতি বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৭৯ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার। এ পাঁচ বছরের মধ্যে ২০১৯ সালে বিদেশি ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে ৫ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলার। ২০২০ সালে বৃদ্ধি পেয়েছে ৮ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলার, যা দেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। ২০২১ সালে তা বৃদ্ধি পেয়েছে ৯ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। ২০২২ সালে সরকারের বিদেশি ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে ৪ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার এবং ২০২৩ সালে বেড়েছে সাড়ে সাত বিলিয়ন ডলার, যা তৃতীয় সর্বোচ্চ।
চতুর্থ মেয়াদের ছয় মাসে বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে ৩ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার। আওয়ামী লীগ চলতি বছরের জানুয়ারিতে চতুর্থবারের মতো পাঁচ বছরের জন্য সরকার গঠন করে। তবে ছয় মাসের মাথায় গণ-আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশে থেকে পালিয়ে যান। এই সরকারের পতনের আগে জুন পর্যন্ত বিদেশি ঋণ রেখে যান ১০৩ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলার।
বিদেশি ঋণ বৃদ্ধির বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধূরী বলেন, বিদেশি ঋণ বেড়ে গেলে কিছুটা তো ঝুঁকি বেড়ে যায় দেশের। বর্তমান ঋণ স্থিতি আমাদের মতো দেশের জন্য অধিক বেশি ঋণ হয়ে গেছে। যদিও এসব ঋণ নেয়া হয়েছিল বড় বড় প্রকল্পের জন্য। ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে আগের সরকার ঠিকমতো পরিকল্পনা করেছে কি না, তা জানা নেই। এমনকি দেশের বৈদেশিক মুদ্রা বাড়ছে না। বৈদেশিক মুদ্রা না বাড়লে তো ঋণ পরিশোধে সমস্যা হবে। তাই রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বাড়ানোর পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগও বাড়াতে হবে।