একটি প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিভাগ-প্রধানের সাফল্যের ওপর নির্ভর করে ওই প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বা সিইওর সফলতা। সিইও সফল হলে প্রতিষ্ঠানটির মুনাফা বেশি হয়। খুশি হন শেয়ারহোল্ডাররা। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে সিইও’র সুনাম। প্রতিষ্ঠানের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও), কোম্পানি সচিব, চিফ মার্কেটিং অফিসারসহ এইচআর প্রধানরা থাকেন পাদপ্রদীপের আড়ালে। টপ ম্যানেজমেন্টের বড় অংশ হলেও তারা আলোচনার বাইরে থাকতে পছন্দ করেন। অন্তর্মুখী এসব কর্মকর্তা সব সময় কেবল প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য বাস্তবায়নে ব্যস্ত থাকেন। সেসব কর্মকর্তাকে নিয়ে আমাদের নিয়মিত আয়োজন ‘টপ ম্যানেজমেন্ট’। শেয়ার বিজের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে এবার এবি ব্যাংকের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রধান মানবসম্পদ ব্যবস্থাপক (অপারেশন) মুহম্মদ নজরুল ইসলাম। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মো. হাসানুজ্জামান পিয়াস
মুহম্মদ নজরুল ইসলাম এবি ব্যাংকের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রধান মানবসম্পদ ব্যবস্থাপক (অপারেশন)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হিসাব বিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষে গ্রামীণফোনে কর্মজীবন শুরু করেন। পরে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ (মেজর-এইচআরএম) সম্পন্ন করেছেন। তিনি বাংলাদেশ সোসাইটি ফর হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্টের (বিএসএইচআরএম) একজন ফেলো
শেয়ার বিজ: ক্যারিয়ার গড়ার পেছনের গল্প দিয়ে শুরু করতে চাই …
মুহম্মদ নজরুল ইসলাম: ২০০০ সালে গ্রামীণফোনে কাস্টমার সার্ভিস অফিসার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করি। সেখানে প্রায় এগারো বছর কাজ করেছি। ফ্রন্ট লাইনে কাস্টমার সার্ভিস থেকে শুরু করে কল সেন্টার, নানা প্রজেক্ট, কমার্সিয়াল ও মার্কেটিংয়ে কাজ করেছি। সবশেষে মানবসম্পদ (এইচআর) ম্যানেজার হিসেবে কাজ করি। এরপর ২০১১ সালে সিটিসেলে ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার অব এইচআর হিসেবে যোগ দিই। সেখানে চার বছর কাজ করার পর ২০১৫ সালে র্যাঙ্কসের মানবসম্পদ ও প্রশাসন বিভাগের প্রধান হিসেবে কাজ করি। ২০১৬ সাল থেকে এবি ব্যাংকের হেড অব এইচআর (অপারেশন) ও সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাজ করছি।
শেয়ার বিজ: কেন বেছে নিলেন এ পেশা?
নজরুল ইসলাম: ইচ্ছা ছিল চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হব। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাকাউন্টিংয়ে ভর্তি হওয়ার পর বুঝতে পারি, আমি অ্যাকাউন্টিং উপভোগ করছি না, মানুষের সঙ্গে মিশতে পছন্দ করি। মানুষের সঙ্গে কাজ করতে, কথা বলতে পছন্দ করি। আমি ডিবেট পছন্দ করি। অ্যাকাউন্টিংয়ের পরিবর্তে কবিতা ও গল্প পড়তে পছন্দ করতাম। একই সঙ্গে নানা সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। স্নাতক শেষে চার্টার্ড অ্যাকাউন্টিং পড়ার সুযোগ পাই। তবে আগ্রহ ছিল না। এ কারণে ওই দিকে না গিয়ে গ্রামীণফোনে যোগ দিলাম। সঙ্গে এমবিএ শুরু করি। এরপর ঢাকার বাইরে পোস্টিং নিলাম। রিজিওনাল একটা প্রকল্পে সফল হই। এরপর মানবসম্পদ বিভাগে কাজ করার অফার পাই। মূলত তখন থেকেই এ পেশায় আছি।
শেয়ার বিজ: প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য বাস্তবায়নে দক্ষ এইচআরের ভূমিকা সম্পর্কে বলুন …
নজরুল ইসলাম: একটা গল্প বলি। তখন দুই মেরুতে বিভক্ত এ বিশ্ব। যুক্তরাষ্ট ও সোভিয়েত ইউনিয়ন। তাদের মধ্যে ঠাণ্ডাযুদ্ধ চলতো। সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রথম চাঁদে নভোযান পাঠালে ইউএস কংগ্রেস সদস্যরা বিচলিত হয়ে পড়েন। ইউএস প্রেসিডেন্ট সবার আগে চাঁদে গিয়ে গবেষণার ঘোষণা দেন। কংগ্রেস বললো, এটা সম্ভব না। এজন্য অনেক সময় দরকার। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট জানান, এ বিষয়ে নাসার বিজ্ঞানীরা কাজ করছে। তারপর কংগ্রেস একটি কমিটি গঠন করলো। বিজ্ঞানীদের প্রস্তুতি দেখার জন্য তারা নাসায় যাবেন। তারা নাসায় যাওয়ার পর দেখলেন, ঝাড়ুদার বিশেষ যত্ন নিয়ে ঝাড়ু দিচ্ছে। তিনি জানান, আমি নাসার জন্য কাজ করছি। আমার বিজ্ঞানীরা কাজ করছে চাঁদে যাওয়ার জন্য। তারা যেন ময়লার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত না হন তা নিশ্চিত করছি। কংগ্রেস কমিটি উপলব্ধি করলো তদন্তের দরকার নেই। যেখানে ঝাড়ুদার পর্যন্ত একই লক্ষ্যে একাগ্রচিত্তে কাজ করছে, সে ভিশন ব্যর্থ হবে না। সন্দেহ ছাড়াই এ লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব। একইভাবে কোনো প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য চেয়ারম্যান বা ব্যবস্থাপনা পরিচালক থেকে শুরু করে ঝাড়ুদার বা গেটম্যান সবাইকে জড়িত থাকতে হয়। তবেই সেখানে সফলতা আসে। আর একজন দক্ষ এইচআর ম্যানেজার প্রতিষ্ঠানের সবাইকে সেই ভিশনের সঙ্গে জড়িয়ে লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য কাজ করেন।
শেয়ার বিজ: ব্যাংকিং খাতে কর্মী নিয়োগের পর তাদের দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে কী কী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়?
নজরুল ইসলাম: এ প্রজন্মের অনেক কর্মীর মধ্যে পেশাদারি মনোভাবের অভাব রয়েছে। আমি মনে করি, আগ্রহ থাকলে জ্ঞান অর্জন করা যায়। তবে পেশাদারি মনোভাব যদি ভেতর থেকে না আসে, সেটি হয় বড় চ্যালেঞ্জ। দেখা যায়, অনেকে একটি প্রতিষ্ঠানে যোগদানের অল্প সময়ের মধ্যে অন্য প্রাতিষ্ঠানে চলে যাওয়ার সুযোগ খুঁজতে থাকে। সুযোগ পেলেই নতুন প্রতিষ্ঠানে চলে যায়। অথচ একজন কর্মী নিয়োগ দেওয়ার বেলায় একটি প্রতিষ্ঠানকে অনেক ধাপ পেরোতে হয়। যেমন নিয়োগ প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে কাজের ধরন নির্ধারণ, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি। অর্থাৎ তার পেছনে প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করে। এসব বিষয় তারা চিন্তা করেন না। এটাই অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। এ মনোভাবের পরিবর্তন জরুরি। অন্য চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিল্পমুখী পড়ালেখা হয় না বললে চলে।
একজন এক্সিকিউটিভের কাছ থেকে ব্যাংক কী চায়? এ বিষয়ে হয়তো দু’একটা কোর্স করানো হয় কিন্তু ব্যাংকিং খাত কীভাবে চলছে তা শেখানো হয় না। অথচ আমরা বলি, একজন কর্মীর মধ্যে তিনটি বিষয়ের সমন্বয় থাকা দরকার জ্ঞান, দক্ষতা ও খাপ খাওয়ানো। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একজন ছাত্র জ্ঞান অর্জন করেছে। কিন্তু কাজের সুযোগ পাচ্ছে না। ফলে দক্ষ হয়ে উঠতে পারছে না। পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতেও তিনি পটু নন। এ তিনটি বিষয়ের সমন্বয় ঘটানো বেশ চ্যালেঞ্জের।
শেয়ার বিজ: মধ্যম পর্যায়ে দক্ষকর্মী থাকলেও উচ্চপর্যায়ে দক্ষ নির্বাহী বা নেতৃত্বের অভাব লক্ষ্য করা যায়, এ ব্যাপারে আপনার মতামত …
নজরুল ইসলাম: কৌশলগত নেতৃত্বের অভাবে এমনটি ঘটছে। নীতি নির্ধারকদের মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা থাকা উচিত। এ জায়গায় ঘাটতি আছে আমাদের। আমরা সবকিছুতে ভালো করছি। কিন্তু কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারছি না। ব্যক্তিগতভাবে অনেকে লাভবান হচ্ছে কিন্তু সমষ্টিগতভাবে কাক্সিক্ষত ফল পাচ্ছি না। কাতারে নিয়ম করা হয়েছিল, যখন কোনো প্রতিষ্ঠান নতুন কর্মী নেবে তখন নির্দিষ্টসংখ্যক স্থানীয় যুবককেও নিয়োগ দিতে হবে। একই সঙ্গে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কতটুকু উন্নয়ন করতে হবে, কোন অবস্থানে যেতে হবে, কীভাবে উন্নয়ন কর্মসূচি পরিচালনা করতে হবে তার দিক নির্দেশনাও দেওয়া হয়। আমরাও এটা নিয়ে ভাবতে পারি। সিনিয়র পজিশন কাভার করতে ক্ষুদ্র পর্যায় থেকে কাজ শুরু করতে পারি। আর টেকসই প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে হলে আপনাকে গুণগতমান ধরে রাখতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা থাকতে হবে। যেমন বর্তমান এমডির স্থলাভিষিক্ত কে হবেন, তা তিন বছর আগে ভাবতে হবে। পাঁচ জনের ডিএমডি পুল থাকতে হবে। পাঁচ জন ডিএমডির জন্য আরও পনেরো জন ভবিষ্যৎ ডিএমডি রাখতে হবে। এভাবে পাইপলাইন তৈরি করতে হবে যাতে সহজে শূন্যস্থান পূরণ করা যায়।
শেয়ার বিজ: ব্যাংকিং খাতে অনেক নারীকর্মী নিয়োগ হলেও মধ্য বা উচ্চপর্যায়ে ক্রমে এ সংখ্যার হার অনেক কম। এর কারণ কী?
নজরুল ইসলাম: ঐতিহ্যগত কারণে নারীরা আগে বাইরে আসতো না। আরেকটি হচ্ছে লাইফস্টাইল। একজন নারীর জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, একজন কর্মজীবী মা কোনো সময়ই ছুটি পান না। ৯টায় অফিসে গেলে ৬ টায় বের হন। এরপর বাসায় গিয়ে রান্না করা। পরের দিন বাচ্চার স্কুলের টিফিন, স্কুল ব্যাগ গোছানো, স্বামীকে প্রয়োজনীয় কাজে সহযোগিতা করা, শ্বশুর শাশুড়ির সেবা-যত্ন করার পর আবার অফিসে যাওয়া। এভাবে শেষ হয় আরেকটি দিন। তাছাড়া দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা, ট্রাফিক সবই তার প্রতিকূলে। এই মানসিক চাপ নিতে নিতে তিনি হাঁপিয়ে ওঠেন। আর আমাদের সমাজব্যবস্থাও তাদের জন্য খুব একটা সহায়ক না। সবশেষে সমাজ ও পরিবারের কথা চিন্তা করেই তিনি তার ক্যারিয়ারকে উৎসর্গ করেন। তারপরও অনেকে আছেন, যারা সব প্রতিকূলতা জয় করে এগিয়ে যাচ্ছেন।
শেয়ার বিজ: ব্যাংকিং সেক্টরে একজন এইচআর ম্যানেজারের জন্য চ্যালেঞ্জিং বিষয় কী?
নজরুল ইসলাম: ব্যাংকিং খাতে কমপ্লায়েন্স বাস্তবায়ন করা অন্যতম চ্যালেঞ্জ। এছাড়া সবার চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হচ্ছে ব্যবসা নিশ্চিত করা। আপনি এইচআর ম্যানেজার হন আর ফাইন্যান্স ম্যানেজারই হন, আপনাকে ব্যবসায় ভূমিকা রাখতে হবে। প্রতিষ্ঠান চায় এইচআর ম্যানেজার হিসেবে আপনি প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবেন।
শেয়ার বিজ: চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় করণীয় কী?
নজরুল ইসলাম: মানসিকতা খুব গুরুত্বপূর্ণ। অনেক চ্যালেঞ্জ আসবে, অনেক জটিলতা তৈরি হবে। সবকিছু ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করতে হবে। অনেক তত্ত্ব উপাত্ত নিয়ে মালিকপক্ষের কাছে যেতে হবে। তাদের কাছে সম্ভাব্য সমাধান তুলে ধরতে হবে। প্রতিষ্ঠানের জন্য কোনটি সুবিধাজনক তা নিয়ে ভাবতে হবে।
শেয়ার বিজ: পেশা হিসেবে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপককে কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
নজরুল ইসলাম: এইচআর ম্যানেজারকে দ্বৈত ভূমিকা পালন করতে হয়। অনেক সময় মালিকপক্ষ চিন্তা করতে পারে, আপনি কর্মীদের পক্ষ নিয়ে কথা বলেন। আবার কর্মীরা আপনাকে মালিকপক্ষের মনে করতে পারে। অর্থাৎ মানবসম্পদ ব্যবস্থাপকের ভূমিকা অনেকটা সেতুর মতো। কর্মী ও ম্যানেজমেন্টর মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা তার কাজ। পেশাটি বেশ ইন্টারেস্টিং। তবে এ পেশার প্রতি আগ্রহ থাকতে হবে। তাছাড়া বাংলাদেশে এ পেশার অনেক সুযোগও রয়েছে।
শেয়ার বিজ: সফল এইচআর ম্যানেজার হতে আপনার পরামর্শ কী?
নজরুল ইসলাম: সফল হতে হলে ব্যবসা বুঝতে হবে। মানুষকে বুঝতে হবে। নিজের সঙ্গে কথা বলতে হবে। কোথায় ভালো করেছি, কোথায় আরও ভালো করার সুযোগ ছিল বা আছে সেটি বুঝে কাজ করতে হবে। ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে হবে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে।
Add Comment