ড. মতিউর রহমান: বাংলাদেশকে বিশ্বের সবচেয়ে জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আমাদের দেশের ঘন জনবসতি, নিচু ভূমি এবং কৃষিনির্ভর অর্থনীতি একে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের জন্য অত্যন্ত সংবেদনশীল করে তুলেছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা এবং অনিশ্চিত আবহাওয়া আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে প্রভাবিত করছে। জলবায়ু পরিবর্তন আর কোনো ভবিষ্যতের হুমকি নয়, বরং বর্তমানে আমাদের সামনে একটি বাস্তব চ্যালেঞ্জ।
এই প্রেক্ষাপটে, জলবায়ু পরিবর্তনের মতো জটিল সমস্যার সমাধানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) একটি অত্যন্ত শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এআই প্রযুক্তি জলবায়ু বিপর্যয়ের সঠিক শনাক্তকরণ এবং তার প্রভাব মোকাবিলায় আরও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে সহায়তা করে। এভাবে এআই লাখো মানুষের জীবন রক্ষা করতে পারে এবং টেকসই ভবিষ্যৎ গড়তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউ এমও) এবং জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের ক্রমবর্ধমান হুমকির মোকাবিলায় নতুন নতুন উপায় খুঁজতে বলেছে। এই পরিস্থিতিতে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কে আগে থেকে সতর্ক করে দেয়া, ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি অনুমান করা এবং এই সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করার ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটাতে পারে। বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্য এই প্রযুক্তি আরও বেশি প্রয়োজনীয়, যেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব খুবই বেশি।
বাংলাদেশের মতো ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্ত দেশে জলবায়ু বিজ্ঞানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) ব্যবহার একটি বিপ্লবী পরিবর্তন আনতে পারে। বিশেষ করে, চরম আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেয়ার ক্ষেত্রে এআই অত্যন্ত কার্যকরী। স্যাটেলাইট চিত্র, আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের তথ্য এবং অতীতের আবহাওয়ার তথ্য বিশ্লেষণ করে এআই মডেলগুলো এমন কিছু নিদর্শন খুঁজে বের করতে পারে যা সাধারণ পদ্ধতিতে ধরা পড়ে না। ফলে, বন্যা, ঘূর্ণিঝড় বা জলোচ্ছ্বাসের মতো বিপর্যয়ের আগেই সতর্কবার্তা দেয়া সম্ভব হয়, যা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাকে আরও কার্যকর করে তুলতে সাহায্য করে।
উদাহরণস্বরূপ, ২০২৩ সালের ডব্লিউএমও-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আবহাওয়া পূর্বাভাস ও সতর্কবার্তা ব্যবস্থাকে বিশ্বব্যাপী আরও নিখুঁত করে তুলছে। বাংলাদেশের মতো দেশে, এআই-চালিত সিস্টেমগুলো ঘূর্ণিঝড় বা বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগাম সতর্কতা দিয়ে মানুষের জীবন বাঁচাতে পারে। বাংলাদেশের বর্তমান বন্যা সতর্কতা ব্যবস্থায় এআই যোগ করলে, আমরা খুব দ্রুত ও সঠিকভাবে পরিবেশের সামান্য পরিবর্তনও ধরতে পারব। ফলে মানুষ আগে থেকেই প্রস্তুতি নিতে পারবে, যা জীবন ও সম্পত্তি রক্ষায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
উপকূলীয় এলাকায় এআই ব্যবহার করে সমুদ্রের উচ্চতা ও তাপমাত্রা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা হলে ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস অনেক সঠিক হবে। এই সিস্টেম সেন্সর থেকে পাওয়া তথ্যকে খুব দ্রুত বিশ্লেষণ করে ঘূর্ণিঝড়ের গঠন এবং কোন দিকে যাচ্ছে তা নির্ধারণ করতে পারে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে এ ধরনের সিস্টেম ইতোমধ্যেই সফল হয়েছে। বাংলাদেশের মতো ঘূর্ণিঝড় প্রবণ দেশে এটি ব্যবহার করলে অনেক মানুষের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষা করা সম্ভব।
দীর্ঘমেয়াদি জলবায়ু ঝুঁকি মূল্যায়নে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) অবদান অপরিহার্য। আগাম সতর্কতার পাশাপাশি, এআই জটিল পরিবেশগত, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বিষয়গুলোকে বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারণা দিতে পারে। বিভিন্ন সম্ভাব্য পরিস্থিতির ভিত্তিতে মডেল তৈরি করে এআই নীতি নির্ধারকদের জানাতে পারে কোন অঞ্চল বা খাতগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনইপি) এক গবেষণায় দেখা গেছে, কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মূল্যায়নে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) খুবই কার্যকর হতে পারে। বাংলাদেশের মতো কৃষি নির্ভর দেশে এআই ব্যবহার করে কৃষিক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি আগেই অনুমান করা সম্ভব। এতে করে কৃষকরা জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চাষাবাদ করতে পারবেন।
কৃষি ক্ষেত্রে এআই-এর ব্যবহার কৃষকদের জন্য এক বড় সুযোগ। এআই তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত এবং মাটির অবস্থা সম্পর্কে সঠিক তথ্য দিয়ে কৃষকদের ফসল বেছে নিতে এবং চাষের সময়সূচি ঠিক করতে সাহায্য করতে পারে। এতে করে কৃষকরা পরিবর্তিত আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে এবং ফসলের ক্ষতি কমাতে পারবে। বিশেষ করে, ধানের মতো জলবায়ু সংবেদনশীল ফসলের চাষে এআই-এর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এআই-এর সাহায্যে কৃষকরা আরও কম খরচে বেশি ফসল উৎপাদন করতে পারবে।
ঢাকার মতো দ্রুত বর্ধনশীল শহরগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই একটি কার্যকর হাতিয়ার হতে পারে। এআই-ভিত্তিক মডেলগুলো বন্যা, তাপপ্রবাহ ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো শনাক্ত করে শহর পরিকল্পনাকারীদের সহায়তা করতে পারে। এই তথ্যের ভিত্তিতে শহরের অবকাঠামোকে আরও মজবুত করে তৈরি করা সম্ভব, যা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে সহ্য করতে সক্ষম হবে। ফলে দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি কমবে এবং শহরবাসীরা আরও নিরাপদ থাকবে।
শনাক্তকরণ এবং অভিযোজন ছাড়াও, এআই বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমনের প্রচেষ্টাতেও সহায়ক হতে পারে। যদিও একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের কার্বন নির্গমন তুলনামূলকভাবে কম, তবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশটি টেকসই শক্তি ব্যবস্থার প্রতি আরও বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। এআই এই রূপান্তরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, বিশেষত শক্তি দক্ষতা উন্নয়ন এবং নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়ানোর ক্ষেত্রে।
এআই বিদ্যুৎ গ্রিডের কার্যকারিতা বাড়াতে এবং নবায়নযোগ্য শক্তি উৎস, যেমন সৌর এবং বায়ু শক্তিকে জাতীয় গ্রিডে একীভূত করতে সহায়ক হতে পারে। এআই প্রযুক্তি বিদ্যুতের চাহিদার পূর্বাভাস দিয়ে এবং তা নবায়নযোগ্য শক্তি উৎসের সরবরাহের সঙ্গে মিলিয়ে কার্যকরভাবে শক্তি অপচয় কমাতে পারে। বাংলাদেশের জন্য, যেখানে নবায়নযোগ্য শক্তি এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে, এই এআই-চালিত সমাধানগুলো একটি সবুজ শক্তি ব্যবস্থার দিকে দ্রুত অগ্রসর হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করবে।
এছাড়াও এআই কার্বন নির্গমন পর্যবেক্ষণে সহায়ক হতে পারে। শিল্পক্ষেত্রে থেকে প্রাপ্ত রিয়েল-টাইম ডেটা ব্যবহার করে, এআই অ্যালগরিদমগুলো নির্গমনের মাত্রা অনুমান করতে পারে এবং কোন খাতগুলো টেকসইতায় পিছিয়ে রয়েছে তা চিহ্নিত করতে পারে। এর মাধ্যমে নীতিনির্ধারকরা আরও কার্যকরভাবে নির্গমন কমানোর লক্ষ্যে পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হবেন, যা প্যারিস চুক্তির লক্ষ্যপূরণের জন্য প্রয়োজনীয়। প্যারিস চুক্তির আওতায় বাংলাদেশের অঙ্গীকার পূরণে এআই একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে।
যদিও বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে, তবে এর কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এআই ব্যবস্থাগুলোর কার্যকারিতা অনেকাংশে ডেটার ওপর নির্ভর করে, তবে দেশের অনেক এলাকায় পর্যাপ্ত মানসম্পন্ন ডেটা সংগ্রহের অবকাঠামো নেই। মেটিওরোলজিক্যাল স্টেশন, সেন্সর এবং ডেটা শেয়ারিং প্ল্যাটফর্মে বিনিয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যাতে এআই-চালিত সমাধানগুলো সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হতে পারে।
এআই প্রযুক্তির সর্বজনীন ব্যবহারে বাংলাদেশে ডিজিটাল বিভাজন একটি বড় বাধা। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠী, যেমন, দূরবর্তী এলাকার বাসিন্দা বা আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী, তারা এআই প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ, জ্ঞান বা অবকাঠামোর অভাব বোধ করে। এই অসমতা কমাতে হলে সরকার এবং বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রেই যৌথ প্রচেষ্টার মাধ্যমে এআই-চালিত জলবায়ু সমাধানগুলো সবার জন্য সহজলভ্য করে তুলতে হবে।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার করার সময়, গোপনীয়তা, ডেটা সুরক্ষা এবং পক্ষপাতমূলকতা এড়ানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যখন এআই সিস্টেম ব্যক্তিগত তথ্য ব্যবহার করে, তখন গোপনীয়তা নিশ্চিত করা জরুরি। এছাড়া এআই অ্যালগরিদমগুলোকে এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে কোনো নির্দিষ্ট সম্প্র্রদায়ের ওপর এর প্রভাব অসমান না হয়। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো যেমন, জাতিসংঘ, সবাইকে দায়বদ্ধ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করার জন্য উৎসাহিত করে, যাতে এই প্রযুক্তি জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে।
বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যেসব দুর্যোগ হচ্ছে, সেগুলো শনাক্ত করতে এবং এর প্রভাব কমাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হতে পারে। এআই প্রযুক্তি দিন দিন উন্নতি করছে এবং এটি জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলায় আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এআই দিয়ে আমরা প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগেই পূর্বাভাস দিতে পারব, কোন এলাকাগুলোয় ঝুঁকি বেশি সেটা বুঝতে পারব, শক্তি সঞ্চয় করতে পারব এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে চলার জন্য নতুন উপায় খুঁজে বার করতে পারব।
বাংলাদেশ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের মারাত্মক প্রভাব থেকে তার জনগণ, অর্থনীতি এবং পরিবেশকে রক্ষা করতে পারে। তবে এই সম্ভাবনা সফল করতে হলে, এআই-চালিত সমাধানগুলোকে কার্যকর করার জন্য ডেটা ব্যবস্থা, শিক্ষা এবং দক্ষতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করা জরুরি। বিশ্বব্যাপী সংস্থা যেমন, বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউএমও) ও জাতিসংঘ (ইউএন) মনে করে যে, এআই শুধু ভবিষ্যতের জন্য নয়, বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়েও একটি গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র। বাংলাদেশের জন্য, এআই-চালিত জলবায়ু সমাধান গ্রহণ করা আগামী প্রজšে§র জন্য একটি টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার এক বিরাট পদক্ষেপ হতে পারে।