বাংলাদেশে ভঙ্গুর অর্থনীতিতে রাজনৈতিক অস্থিরতা বড় ঝুঁকি

শেয়ার বিজ ডেস্ক: রাজনৈতিক অস্থিরতা বাংলাদেশের নড়বড়ে অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিচ্ছে। আগামী জানুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে বিরোধী দলগুলো আন্দোলন করছে। এতে ভঙ্গুর অর্থনীতির জন্য উচ্চ ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে। কাতারের গণমাধ্যম আল জাজিরায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বিরোধী দল বিএনপি এবং তার মিত্ররা জাতীয় নির্বাচন তদারকি করার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন করছে। কারণ তারা বিশ্বাস করে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না।

অন্যদিকে শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগ ২০০৯ সাল থেকে ক্ষমতায় রয়েছে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত গত দুটি নির্বাচন যথাক্রমে বর্জন করেছিল বিরোধী দল এবং মারাত্মক ভোট জালিয়াতির অভিযোগ রয়েছে।

বিশ্বে সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী নারী সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা। ক্ষমতার প্রায় ১৫ বছরে বিরোধী দল এবং ভিন্ন মতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে নৃশংস দমনপীড়ন চালানোর অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

বাংলাদেশের সংসদ ২০১১ সালে জাতীয় সংসদ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। এটি হলো নির্বাচনকালীন একটি নিরপেক্ষ প্রশাসন। তারা দক্ষিণ এশিয়ার এ দেশটিতে ১৯৯০-এর দশকের শুরুতে সামরিক স্বৈরাচারের কাছ থেকে দেশকে গণতন্ত্রে ফেরানোর জন্য কমপক্ষে চারটি নির্বাচন সফলভাবে সম্পন্ন করেছে। এসব নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি উভয়েই ক্ষমতায় এসেছে।

কয়েক বছর ধরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করছে বিএনপি। কিন্তু তাদের এ দাবির জবাব দেয়া হচ্ছে পুলিশি নৃশংসতা ও হাজার হাজার মামলার মাধ্যমে। এখন দলটি এবং তার মিত্ররা জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে কর্মসূচি দেয়ার প্রত্যয় ঘোষণা করেছে। নভেম্বরের শুরু থেকে

তারা দেশব্যাপী ধারাবাহিকভাবে অবরোধ ঘোষণা করছে। কিন্তু এসব রাজনৈতিক অচলাবস্থার খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ বাংলাদেশিদেরই।

একটি ট্রাভেল এজেন্সির নির্বাহী রাহুল আমিনকে খুব কম বাস, অটোরিকশা ও ট্যাক্সি চলার কারণে সাধারণ সময়ের চেয়ে কমপক্ষে ১০ গুণ ভাড়া দিতে

হচ্ছে অফিসে যেতে। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, এমনিতেই গত বছর থেকে খাদ্যের দাম বৃদ্ধি এবং মূল্যস্ফীতির বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই করতে হচ্ছে। আর এখন এই রাজনৈতিক টালমাটাল পরিস্থিতির খড়গ পড়েছে বাজারে। তিনি আরও বলেন, বিরোধী দলের অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবির বিষয়টি আমি বুঝতে পারি। যদি এই অবরোধ অব্যাহত থাকে তাহলে পুরো অর্থনীতি থমকে দাঁড়াবে।

আল জাজিরার প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, রাজনৈতিক উত্তেজনাকর অচলাবস্থা দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতির ওপরও মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। এই অর্থনীতি এমনিতেই কভিড-১৯ মহামারি এবং ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে সংকুচিত হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া ও শক্তিশালী মূল্যস্ফীতি সরকারকে এ বছরের শুরুতে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) কাছে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ চাইতে চাপ দিয়েছে।

সম্প্রতি এক পাবলিক ফোরামে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার স্বীকার করেছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। এখন খুব কঠিন সময় পার করছি।

জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানির ঘাটতি বেড়েছে ২ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস, পুঁজি এবং সেবা খাতের আমদানি-রপ্তানির চেয়ে অনেক বেশি। একই সময়ে এর কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ঘাটতি বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন ডলার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে দাঁড়িয়েছে ২০ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলারে।

গত মাসে রপ্তানি আয়, যার সিংহভাগ আসে তৈরি পোশাক শিল্প খাত থেকে, তা ১৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলারে। এক্সপোর্ট প্রোমোশন ব্যুরোর তথ্যমতে, গত ২৬ মাসে এই পরিমাণ সর্বনিম্ন।

রপ্তানি আয়ের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক লাইফলাইন হলো বাইরে থেকে আসা রেমিট্যান্স। তা এ বছরের শেষ প্রান্তিকে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ কমে গেছে। এখন এফবিসিসিআই বলছে, অবরোধে প্রতিদিন বাংলাদেশের লোকসান হচ্ছে ৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।

এফবিসিসিআইয়ের প্রেসিডেন্ট মাহবুবুল আলম আল জাজিরাকে বলেছেন, এই অবরোধে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ছোট-বড় সব ব্যবসা। এর আগেও আমরা দেখেছি নির্বাচনের আগেও রাজনৈতিক সহিংসতা কীভাবে অর্থনীতির ক্ষতি করে।

একই রকম সতর্কতা দিয়েছেন ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা ২০১৪ সালের মতো। ওই সময় কয়েক বিলিয়ন ডলারের মতো ক্ষতি হয়েছিল। কিন্তু এখন এই ক্ষতি আরও বেশি হবে। এর কারণ, অর্থনীতি বড় এ জন্য নয়। কারণ হলো ‘বাফার’ খুব কমে যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের জন্য শুধু রাজনৈতিক অচলাবস্থাকে দায়ী করা যায় না। তিনি বলেন, এই অবস্থা চলছে কমপক্ষে ১৫ মাস ধরে এবং তা চলছেই। যখন বৈশ্বিক চাপ এতে ভূমিকা রেখেছে, তখন দেশের অর্থনীতি, বিনিময় হার, আর্থিক ও অর্থনীতি সংশ্লিষ্ট প্রতিক্রিয়াও সহায়ক হয়নি।

কভিড মহামারির শুরু থেকে বাংলাদেশে গত জুলাই পর্যন্ত কমপক্ষে তিন বছর ঋণের হার শতকরা ৯ ভাগে সীমাবদ্ধ ছিল। এতে সুবিধা পেয়েছে ব্যবসায়ীরা। তারা অর্থ নিয়েছেন। এক্ষেত্রে রিয়েল ইন্টারেস্ট ছিল প্রায় শূন্য। ঋণের হার থেকে মূল্যস্ফীতি বাদ দিলে যা হয় তাকে রিয়েল ইন্টারেস্ট রেট বলা হয়।

অর্থনৈতিক বিশ্লেষক জিয়া হাসান বলেন, রাজনৈতিক অচলাবস্থা স্পষ্টত অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। ব্যালান্স অব পেমেন্টকে ঘিরে লড়াই এবং ডলার রিজার্ভের বিষয়টি বাংলাদেশের আমদানিনির্ভর ও বহুমুখী অর্থনৈতিক কাঠামোকে আরও দুর্বল করবে।

বাংলাদেশি একটি থিংক ট্যাংক সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে দুর্নীতির কারণে লোকসান হয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০