বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অবলম্বনে

বাংলাদেশে মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ও বিশ্ব শরণার্থী দিবস



মো. তৌহিদুল ইসলাম: পৃথিবীতে প্রতি মিনিটে প্রায় ২০ থেকে ২৫ ব্যক্তি যুদ্ধ, সন্ত্রাস ও নিপীড়নের শিকার হয়ে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। ১৯৫১ সালের জাতিসংঘের শরণার্থী কনভেনশন অনুসারে, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র ও রাজনৈতিক ভিন্নমতের কারণে নির্যাতিত হয়ে নিজের বাড়ি ও দেশ থেকে নির্বাসিত হওয়া ব্যক্তিরা শরণার্থী। সারা পৃথিবীতে এই শরণার্থীরা সবচেয়ে বেশি অরক্ষিত (ঠঁষহবৎধনষব) অবস্থায় আছে। করোনা মহামারির কারণে বিশ্বব্যাপী বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীগুলো আরও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার মধ্যে পড়েছে। এ ছাড়া দারিদ্র্যের কারণে কাজের সন্ধানে বিভিন্ন দেশে গমনকারী ব্যক্তিদের অনেকে চাকরি হারিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। অনেক মানুষ মানবপাচারের শিকার হয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত লিবিয়াসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অসহনীয় কষ্ট ভোগ করছে। মানব পাচারের বিপক্ষে বাংলাদেশ সরকারের কঠোর অবস্থানের পরও কিছু বাংলাদেশি নাগরিক পাচারের শিকার হচ্ছে।

ইউএনএইচসিআরের তথ্যমতে, বিশ্বে প্রায় সাত কোটি আট লাখ মানুষকে জোর করে বাস্তুচ্যুত করা হয়েছে। তাদের অর্ধেকেরই বয়স ১৮ বছরের নিচে। তাদের মধ্যে দুই কোটি ৫৯ লাখ শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃত। এ শরণার্থীদের মধ্যে রয়েছে ফিলিস্তিনের ৫৫ লাখ মানুষও। বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা শরণার্থীদের আর্থিক ও খাদ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহায়তা দিয়ে থাকে। পৃথিবীতে অসহিষ্ণুতা, হিংসা, বিদ্বেষ ও অন্যের ন্যায়সংগত অধিকার হরণ করার প্রবণতার কারণে জোর করে বাস্তুচ্যুত করা মানুষের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে।

বাংলাদেশ ১৯৫১ সালের জাতিসংঘের শরণার্থী কনভেনশনের স্বাক্ষরকারী দেশ নয়। তারপরও বাংলাদেশ সব সময় বিশ্বের নির্যাতিত ও নিপীড়িত মানুষের পাশে থাকতে অঙ্গীকারবদ্ধ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর পররাষ্ট্রনীতিতে সব সময় বিশ্বের নির্যাতিত ও নিপীড়িত মানুষের পাশে থাকার অঙ্গীকার করেছিলেন। এখনও বাংলাদেশ এ নীতিই অনুসরণ করে চলেছে। আর এ বিষয়টি বাংলাদেশের সংবিধানের ২৫ ধারায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ বিশ্বের সর্বত্র নিপীড়িত জনগণের ন্যায়সংগত সংগ্রামকে সমর্থন করবে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের জনগণ শরণার্থী হিসেবে জীবনযাপনের তিক্ত অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিল। প্রায় এক কোটি জনগণ শরণার্থী হিসেবে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর থেকে এদেশের সরকার ও জনগণ শরণার্থী ও নির্যাতিত মানুষের প্রতি অধিক সমব্যথী এবং সব সময় তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে।

সম্পূর্ণ মানবিক কারণে মিয়ানমারের ১১ লাখ বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশ সাময়িকভাবে আশ্রয় দিয়েছে। বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ মিয়নমারের বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে প্রথম আশ্রয় নিয়েছিল ১৯৭৮ সালে। সে সময় বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের সবাই স্বদেশে ফেরত গিয়েছিল। তার পর থেকে কয়েকবার তারা মিয়ানমারে নির্যাতিত হয়ে এদেশে আশ্রয় নিয়েছিল। সর্বশেষ তারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে ২০১৭ সালে। এর আগে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ মিয়ানমারে ফেরত গেলেও ২০১৭ সালে এ দেশে আসা বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কাউকে মিয়ানমার সরকার ফেরত নেয়নি। রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরত নেওয়ার বিষয়ে ২০১৭ সালে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। কিন্তু মিয়ানমার সে চুক্তি উপেক্ষা করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বিলম্বিত করছে। পরে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার সঙ্গে চীনসহ অন্যান্য দেশ সম্পৃক্ত হলেও এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি দৃষ্টিগোচর হয়নি। বাংলাদেশের জনগণ ও সরকার প্রত্যাশা করে খুব শিগগিরই মিয়ানমার সরকার সে দেশের জোর করে বাস্তুচ্যুত করা জনগণকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে তাদের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠাসহ এ এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখবে। যদিও আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নির্যাতনের বিচার প্রক্রিয়া চলমান আছে। এ বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সে দেশের সরকার ও নির্যাতনকারীদের জবাবদিহি নিশ্চিত করার মাধ্যমে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ হতে পারে।

মিয়ানমারের জোর করে বাস্তুচ্যুত করা রোহিঙ্গারা উন্নয়নশীল ও ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের আকর্ষণীয় পর্যটন এলাকা কক্সবাজারের পরিবেশের ওপর এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। রোহিঙ্গাদের বিপুলসংখ্যক উপস্থিতিতে এ অঞ্চলের স্থানীয়রা সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে। কক্সবাজারের স্থানীয় জনগণের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডেও রয়েছে এর নেতিবাচক প্রভাব। কিছু এনজিও ও আন্তর্জাতিক সংস্থা রোহিঙ্গাদের সাহায্য করলেও এ সংস্থাগুলো থেকে এখানকার স্থানীয় দরিদ্র জনগণ কোনো ধরনের সহযোগিতা পাচ্ছে না। রোহিঙ্গারা কম মজুরিতে কাজ করায় স্থানীয়রা চাকরি হারাচ্ছে। দেশের অধিকাংশ মন্ত্রণালয়কে রোহিঙ্গাদের বিষয়ে কাজ করতে হচ্ছে। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ অনেক সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী রোহিঙ্গাদের তদারকি করার জন্য সরাসরি কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন।

এতে দেশের জনবলের পাশাপাশি সরকারের আর্থিক সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। সম্প্রতি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করার কারণে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে উচ্ছৃঙ্খল রোহিঙ্গারা ক্যাম্প ইনচার্জসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ওপর আক্রমণ করে। তারা মাদকব্যবসা, চোরাকারবারসহ বিভিন্ন অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ছে। তাদের নিজ ভূমি মিয়ানমারে প্রত্যাবাসিত না হলে এবং এ প্রক্রিয়া দীর্ঘ হলে তারা বিভিন্ন সন্ত্রাসী কাজে জড়িয়ে পড়বে। ফলে তারা এ অঞ্চলের প্রতিটি দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে।

রোহিঙ্গা সমস্যা মিয়ানামারের সরকার ও জনগণের অভ্যন্তরীণ বিষয়। সে দেশের জনগোষ্ঠীর নিরাপদ প্রত্যাবাসন এবং তাদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব মিয়ানমার সরকারের। এ সমস্যা সৃষ্টি করেছে মিয়ানমার এবং এর সমাধান করতে হবে সে দেশের সরকার ও জনগণকে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে তাদের দেশে ফেরত নেওয়ার ক্ষেত্রে মিয়ানমারকে বাধ্য করার বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। পৃথিবীর অনেক দেশ ও সংস্থা মানবাধিকারের বিষয়ে সোচ্চার থাকলেও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার রক্ষায় এবং তাদের ওপর নির্যাতন বন্ধে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারেনি। রোহিঙ্গারা মিয়ামারে নির্যাতিত হয়ে গভীর সমুদ্রে নৌকায় ভাসমান থাকলেও কোনো দেশ তাদের উদ্ধারে এগিয়ে আসেনি। তাদের মানবাধিকার রক্ষায় এবং তাদের আশ্রয় দেওয়ার ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশকেও দায়িত্ব নিতে হবে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা নির্যাতিত হতে থাকলে তারা তাদের স্বদেশ থেকে পালিয়ে বিভিন্ন দেশে প্রবেশের চেষ্টা করবে। এছাড়া তারা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে পারে, যা এ অঞ্চলসহ পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের উন্নয়ন ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াবে।

বিশ্বের নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের ন্যায়সংগত অধিকার ফিরিয়ে দিতে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত ও প্রভাবশালী দেশগুলোর আরও বলিষ্ঠ ভূমিকা প্রত্যাশা করে বাংলাদেশের সরকার ও জনগণ। আন্তর্জাতিক ফোরামে সব সময় পৃথিবী থেকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য দূর করার বিষয়ে বাংলাদেশ সোচ্চার। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জাতিগত সংঘাত বন্ধে, শান্তি প্রতিষ্ঠায় এবং অসামরিক মানুষকে রক্ষায় জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীতে বাংলাদেশ নেতৃস্থানীয় ভূমিকা রেখে চলেছে। এ সংস্থায় বাংলাদেশ ১৯৮৮ সাল থেকে সুনামের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। জাতিসংঘের ৪২টি শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের এক লাখ ৭০ হাজার ২২১ জন শান্তিরক্ষী এ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেছে। বর্তমানে ছয় হাজার ৫৪৩ বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী জাতিসংঘের ৯টি মিশনে দায়িত্ব পালন করছেন।

শরণার্থী সৃষ্টির মূল কারণ যুদ্ধ, নির্যাতন, দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করে বিশ্বব্যাপী শান্তি প্রতিষ্ঠায় বিশ্বের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থাগুলোকে এগিয়ে আসা উচিত। দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও ন্যায়পরায়ণতা অত্যাবশ্যক। ভবিষ্যতে যেন আর কাউকে বাস্তুচ্যুত না হতে হয়, সে বিষয়ে এখনই বিশ্বনেতাদের ঐকমত্য প্রয়োজন। এ ধরনের উদ্যোগের মাধ্যমে শরণার্থী ও জোর করে বাস্তুচ্যুত করা জনগোষ্ঠীর মানবেতর জীবনের সমাপ্তি ঘটাতে পারে। শিগগিরই বিশ্ব থেকে সব ধরনের নির্যাতন ও বৈষম্যের অবসানের পাশাপাশি সাত কোটির অধিক জোর করে বাস্তুচ্যুত করা মানুষের মানবাধিকার ফিরিয়ে দেওয়া হবে এবং তারা স্বাভাবিক জীবন ফিরে আসবে শরণার্থী দিবসে এটাই বিশ্ববাসীর  প্রত্যাশা।

পিআইডি নিবন্ধন



 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০