Print Date & Time : 18 June 2025 Wednesday 10:36 pm

বাংলাদেশে যব চাষের সম্ভাবনা

একটি উচ্চমূল্যের ফসল বার্লি বা যব। এটি চাষ করে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রফতানি করা সম্ভব। আজ এর বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হলো

দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে বার্লি বা যব চাষ হচ্ছে। শস্যটি আমাদের দেশে ‘পায়রা’ নামেও পরিচিত। বর্তমানে দেশের আবাদি জমির প্রায় ০.১০ শতাংশ জুড়ে এর চাষ হয়। তবে বোরো ধান, গম, ভুট্টাসহ অন্যান্য ফসলের চাষ বিস্তার পেয়েছে। ফলে বার্লির আবাদ কমছে।
বার্লি রবি মৌসুমের ফসল। বার্লি সবচেয়ে বেশি আবাদ হয় টাঙ্গাইলে। এর পরের অবস্থান যথাক্রমে ঢাকা ও পাবনা।
বার্লি দিয়ে রুটি তৈরি করা হয়। ছাতু হিসেবেও বার্লি খাওয়ার চল রয়েছে। শিশুখাদ্য হিসেবে রবিনসন, ওভালটিন, হরলিকস, হ্যামিলটন ও আলবার্টা বার্লির মূল উপাদান বার্লি বা যব।
বার্লি একটি পুষ্টিকর খাদ্য। এর মধ্যে রয়েছে ৬১.৮ শতাংশ শর্করা, ১৩.১ শতাংশ আমিষ, অদ্রবনীয় আঁশ ৮.৮৫ শতাংশ, আর্দ্রতা ৭.৫৫ শতাংশ, দ্রবনীয় আঁশ ৮.৮৫ শতাংশ, পেনটোসান ৪.২৮ শতাংশ, লিপিড ২.৯২ শতাংশ, ছাই ১.৮৯ শতাংশ ও অন্যান্য উপাদন ৪.২৬ শতাংশ। ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত রোগীর জন্য বার্লি একটি পুষ্টিসমৃদ্ধ পথ্য। বার্লির মধ্যে পানিতে দ্রবনীয় আঁশ ও করোনেল রয়েছে। এসব উপাদান রক্তের কোলেস্টেরল কমাতে সহায়তা করে।
বিভিন্ন খাদ্যশিল্পে বার্লির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। অথচ উৎপাদিত বার্লিতে দেশের চাহিদা পূরণ হয় না। এজন্য আমদানি করতে হয়। বোঝাই যাচ্ছে, আমাদের দেশে বার্লি চাষ বিস্তারের সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততার কারণে রবি মৌসুমে সেখানে অন্য কোনো ফসল ফলে না। এসব স্থানে বার্লির আবাদ করা যেতে পারে। কারণ বার্লি যথেষ্ট লবণ সহ্য করতে পারে। আশার কথা, তামাক চাষ বাদ দিয়ে সে জমিতে বার্লির আবাদ বিস্তার করা যেতে পারে।
নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, পটুয়াখালী ও বরগুনার প্রায় এক লাখ একর জমিতে বার্লি আবাদের সম্ভাবনা রয়েছে। অগ্রহায়ণে রোপা আমন ধান কাটার পর এ জমিতে বার্লির আবাদ করা যায়। চৈত্রে বার্লি ফসল কাটার পর ওই জমিতে আউশ ধানের আবাদ করা যেতে পারে। আউশ ধানের পর রোপা আমনের আবাদ করা যায়। ফলে বর্তমানে প্রচলিত এক ফসল রোপা আমন ধানের জমি তিন ফসলি জমিতে (বার্লি-আউশ ধান-রোপা আমন ধান) রূপান্তরের সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।
বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে গমের ফলন ব্যাহত হচ্ছে। সাধারণভাবে খরা ও উচ্চ তাপমাত্রায় গমের চেয়ে বার্লি বেশি সহনশীল। ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে গমের পরিবর্তে বার্লির উপযুক্ত জাত বাছাই পরীক্ষা পরিচালনা করা যেতে পারে।
জানা গেছে, খরাপ্রবণ চরাঞ্চলে কিছু স্থানীয় জাতের বার্লির চাষ হচ্ছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে সাতটি বার্লির জাত (বারি বার্লি-১ থেকে বারি বার্লি-৭) ছাড় করা হয়েছে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা মোকাবিলার জন্য বার্লির তাপ, খরা ও রোগবালাই প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন জাত বাছাই প্রভৃতি বিষয় নিয়ে গবেষণা করা যেতে পারে।
বার্লি উৎপাদন বাড়ানোর মাধ্যমে দেশজ চাহিদা পূরণ করে আমদানিনির্ভরতা কমানো সম্ভব। ফলে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করা যাবে। একই সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যেমন অস্ট্রেলিয়া, চীন, জাপান ও সৌদি আরবে বার্লি রফতানি করা যাবে। বার্লি একটি উচ্চমূল্যের ফসল হিসেবে গণ্য। বার্লির উৎপাদন বাড়িয়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ রয়েছে।

 

বার্লি বা যবের কয়েকটি দিক
পোয়াসিয়া পরিবারের অন্তর্ভুক্ত ও শস্য বা বিরুৎ-জাতীয় উদ্ভিদ বার্লি। এটি গম-জাতীয় এক ধরনের শস্যদানা। গম আর যবÑউভয়েই একই পরিবারভুক্ত। স্বল্পজীবী ঘাস-জাতীয় উদ্ভিদ থেকে সংগ্রহ করা হয় বার্লি। বর্তমানে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশে সীমিত পরিমাণে এর চাষাবাদ হয়। এটি প্রচুর পরিমাণে উৎপাদন করা যায়।
যব মনোকট শ্রেণির উদ্ভিদ। এ শ্রেণির উদ্ভিদগুলো সাধারণত একবীজপত্রী হয়। এ ধরনের উদ্ভিদে একটি মাত্র বীজপত্র থাকে বলে একে একবীজপত্রী উদ্ভিদ বলা হয়।
যবের ছাতু খুবই উপাদেয় একটি খাদ্য। যদিও আমাদের দেশে যবের ছাতুর প্রচলন নেই। স্বাদের দিক থেকে যব কিছুটা নোনতা ও উষ্ণ প্রকৃতির। যবে রয়েছে মালটোজ, গ্লুকোজ, স্যাকারিন, লেসিথিন, এল্যানটয়েন, এমাইলেস, ভিটামিন-বি প্রভৃতি।
যবের বহু ব্যবহার চোখে পড়ে। গবাদিপশুর প্রধান খাদ্য হিসেবে যব ব্যবহার করা হয়। এর দানা দিয়ে বিভিন্ন ধরনের পানীয় তৈরি করা হয়। বিভিন্ন ধরনের সুষম খাদ্য প্রস্তুতের উপাদান হিসেবেও দেওয়া হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে খাওয়ার স্যুপ ও স্টু তৈরিতে এর ব্যবহার রয়েছে।

রোগবালাই ব্যবস্থাপনা
পাতা ঝলসানো রোগ দমন
ডেক্সলেরা প্রজাতির ছত্রাক এ রোগটি ছড়ায়। বার্লির সবুজ পাতায় ঈষৎ বাদামি রঙের ছোট ডিম্বাকার দাগ পড়ে। পরবর্তী সময়ে দাগ বাড়তে থাকে ও গাঢ় বাদামি থেকে কালো বর্ণ ধারণ করে। দাগ একত্রিত হয়ে সম্পূর্ণ পাতা বাদামি বর্ণ ধারণ করে। তখন ঝলসানোর লক্ষণ দেখা যায়। ফসলের পরিত্যক্ত অংশ, বীজ ও বায়ুর মাধমে এ রোগটি ছড়ায়।

প্রতিকার
গাছের পরিত্যক্ত অংশ সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে

টিল্ট ২৫০ ইসি (০.০৪ শতাংশ) এক মিলি ওষুধ আড়াই লিটার পানিতে মিশিয়ে ১০ থেকে ১২ দিন পরপর দুই থেকে তিনবার স্প্রে করতে হবে

ভিটাভেক্স-২০০ প্রতি কেজি বীজে ২.৫ থেকে তিন গ্রাম মিশিয়ে বীজ শোধন করতে হবে।
গোড়া পচা রোগ দমন
স্কেলেরোসিয়াম রলফসি নামের ছত্রাকের আক্রমণে এ রোগ হয়ে থাকে। প্রায় সব ক্ষেত্রে মাটির কাছাকাছি থাকা কাণ্ড ও মূলের সংযোগস্থলে আক্রমণ করে। প্রথমে গাছের গোড়ায় হলদে দাগ দেখা যায়। পরে দাগ গাঢ় বাদামি হয়ে আক্রান্ত স্থানের চারদিক ঘিরে ফেলে। ফলে গাছ শুকিয়ে মরে যায়। অনেক সময় গাছের গোড়া ও মাটিতে সরষেদানার মতো বাদামি থেকে কালো রঙের স্কেলেরোসিয়া গুটি দেখা যায়। রোগের জীবাণু মাটি বা ফসলের পরিত্যক্ত অংশে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকে। বৃষ্টি ও সেচের পানির মাধ্যমে বিস্তার লাভ করে। আর্দ্রতাপূর্ণ মাটিও রোগটি দ্রুত ছড়ায়।

প্রতিকার

সব সময় মাটিতে পরিমিত আর্দ্রতা বজায় রাখতে হবে

ভিটাভেক্স-২০০ (প্রতি কেজি বীজে আড়াই থেকে তিন গ্রাম) মিশিয়ে বীজ শোধন করে বপন করতে হবে

 

বার্লি চা’র অনেক গুণ
চা-পানে অভ্যস্তÑএমন যে কেউ বার্লি চা’র কথা শুনে থাকবেন। এ চা’র রয়েছে নানা উপকার। এ ধরনের চা শরীরকে বিষমুক্ত ও সতেজ রাখে। এ চা’তে নেই কোনো ক্যাফেইন।
বার্লি হজমে সহায়ক। প্রাকৃতিক উপায়ে শরীর থেকে ক্ষতিকারক পদার্থ দূর করে। দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানে এ চা’র কদর রয়েছে। এটি গরম বা ঠাণ্ডাÑদুভাবেই খাওয়া যায়। বাড়িতে বসে সহজে বার্লি দিয়ে তৈরি এ চা খেতে পারেন। দেখে নিন এর কয়েকটি গুণ:

মন চাঙা করে, উদ্বেগ দূর করে বার্লি চা

মনকে প্রশান্ত করে তোলে

হারবাল ওষুধের মতো কাজ করে বার্লি চা

এতে রয়েছে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট। এটি ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধী হিসেবে কাজ করে। উচ্চ আঁশযুক্ত এ চায়ে ভিটামিন ও খনিজ দ্রব্য পাওয়া যায়। এসব উপাদান দেহের কোষের ক্ষতি ঠেকাতে সহায়ক

শরীরকে বিষমুক্ত করতে পারে বার্লি চা

এটি রক্ত পরিশুদ্ধ করে। এতে পাইরাজিন নামের বিশেষ উপাদান আছে, যা রক্ত সঞ্চালন উন্নত করে

বার্লি চা লিভার বা যকৃতের জন্য ভালো। বিশেষ করে যকৃৎ থেকে বিষাক্ত উপাদান দূর করে

শরীরের অতিরিক্ত চর্বি ভাংতে সহায়তা করে। এ চা পান করলে ওজন কমে

মূত্রনালির সংক্রমণ ঠেকাতে বিশেষভাবে কাজ করে বার্লি চা

হজম বাড়াতে সাহায্য করে

এ চা অন্ত্রের নড়াচড়া বাড়ায় ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। পাকস্থলী পরিষ্কার রাখে

প্রাকৃতিক অ্যান্টাসিড হিসেবে কাজ করে বার্লি চা। ফলে বদহজম, বুকজ্বালা ও পেটের সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়

বার্লি চা শরীর শীতল রাখে। শরীরের তাপমাত্রা ঠিক রাখে

ঘুমে সমস্যা দূর করতে বার্লি চা খেতে পারেন। এতে রয়েছে মেলাটোনিন ও ট্রিপটোফ্যান। এ দুই উপাদান ভালো ঘুম এনে দিতে পারে

সর্দি-কাশি ঠেকাতে কার্যকর দাওয়াই বার্লি চা। একই সঙ্গে গলা ব্যথা, নাক বন্ধ হওয়া প্রভৃতি সমস্যার সমাধানে প্রাকৃতিক ওষুধ হিসেবে কাজ করে।

তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া
কৃষি-কৃষ্টি ডেস্ক