Print Date & Time : 19 June 2025 Thursday 5:28 am

বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের

নিজস্ব প্রতিবেদক: নোবেলবিজয়ী মার্কিন অর্থনীতিবিদ রবার্ট লুকাস বলেছিলেন, শুধু সস্তা শ্রম ও কাঁচামাল থাকলেই যে বিদেশি পুঁজি আকর্ষণ করা যাবেÑএটি সঠিক নয়। দেশের পরিকাঠামো ও পরিবেশ বিনিয়োগযোগ্য হতে হবে। সবার ওপরে দরকার আর্থিক নীতির নির্ভরতা। তাহলেই বিদেশি বিনিয়োগ আসতে শুরু করে। একটি বিদেশি কোম্পানি ভালো ব্যবসা করলে অন্যদের কাছে তার খবর পৌঁছে যায়। আর এতেই বিদেশি বিনিয়োগ আসাটা ক্রমে সহজ হয়ে যায়। সে উক্তিটি কতটুকু সত্যি, তা বাংলাদেশকে দেখেই বোঝা যায়।

সস্তা শ্রম ও কাঁচামাল সহজলভ্য হওয়ার পরও বাংলাদেশ আশানুরূপ বিদেশি বিনিয়োগ পাচ্ছে না। স্বাধীনতার পর ৫২ বছরেও বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) স্টক ২২ বিলিয়ন ডলারের নিচে। কয়েক বছর আগেও বাংলাদেশের বছরে এক বিলিয়ন ডলার বিদেশি বিনিয়োগ পেতে কষ্ট হয়ে যেত। আর অবকাঠামোসহ নানা খাতে উন্নয়নের পরও সাম্প্রতিক বছরগুলোয় তা দুই থেকে তিন বিলিয়ন ডলারের ঘরে ঘুরছে। অথচ প্রতিদ্বন্দ্বী অনেক দেশ যেখানে পাঁচ থেকে ১০ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত বিদেশি বিনিয়োগ পায় বছরে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সম্প্রতি প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরশেষে বাংলাদেশে এফডিআই স্টক দাঁড়িয়েছে ২১ দশমকি ৮২৩ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করেছে তিনটি দেশ। এগলো হলোÑযুক্তরাষ্ট্র, চীন ও যুক্তরাজ্য। এ তিন দেশেরই বাংলাদেশে বিনিয়োগ মোট এফডিআইয়ের ৪৪ শতাংশ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগকারী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশে মোট বিদেশি বিনিয়োগের ১৮ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রের।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৯৪৮ বিলিয়ন ডলার, যা এফডিআই স্টকের ১৮ দশমিক ০৯ শতাংশ। বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ গ্যাস ও পেট্রোলিয়াম খাতে। দেশটির শেভরন একক কোম্পানি হিসেবে বর্তমানে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি গ্যাস সরবরাহ করছে। এছাড়া আরও কয়েকটি মার্কিন গ্যাস কোম্পানি বাংলাদেশে বিনিয়োগ করেছিল।

যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলো বাংলাদেশের গ্যাস খাতে বিনিয়োগ করেছে ২ দশমিক ৮১৫ বিলিয়ন ডলারের, যা দেশটির মোট বিনিয়োগের ৭১ দশমিক ২৯ শতাংশ। এছাড়া বিমা খাতে ২৭১ মিলিয়ন ডলার, নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ২২৯ মিলিয়ন ডলার, ব্যাংক খাতে ২১৩ মিলিয়ন ডলার, বিদ্যুৎ খাতে ১৫১ মিলিয়ন ডলার ও টেক্সটাইল খাতে ১৪৭ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য।

বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে চীনের অবস্থান দ্বিতীয়। গত অর্থবছর শেষে দেশটির বিনিয়োগের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক ৮৫০ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশের মোট এফডিআই স্টকের ১৩ দশমিক ০৫ শতাংশ। চীন বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করে বিদ্যুৎ খাতে। দেশটি এ খাতে এখন পর্যন্ত ২ দশমকি ২৪৭ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে, যা চীনের মোট বিনিয়োগের ৭৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ। এর বাইরে দেশটি টেক্সটাইল খাতে ২৬৯ মিলিয়ন ডলার, ট্রেডিং খাতে ১০৩ মিলিয়ন ডলার ও নির্মাণ খাতে ৬১ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে।

তৃতীয় অবস্থানে থাকা যুক্তরাজ্যের গত অর্থবছর শেষে বাংলাদেশে বিনিয়োগ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশের এফডিআই স্টকের ১২ দশমিক ৯২ শতাংশ। প্রতিবেদন অনুযায়ী, যুক্তরাজ্য বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করে ব্যাংক ও টেক্সটাইল খাতে। গত অর্থবছর শেষে দেশটির ব্যাংক খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ৪৬৪ বিলিয়ন ডলার, যা মোট বিনিয়োগের ৫১ দশমিক ৯২ শতাংশ। আর টেক্সটাইল তথা বস্ত্র খাতে বিনিয়োগ দাঁড়িয়েছে ৪৯৯ মিলিয়ন ডলার, যা মোট বিনিয়োগের ১৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ। এ দুই খাতের বাইরে খাদ্য খাতে ৩১৫ মিলিয়ন ডলার, বিদ্যুৎ খাতে ১৭৮ মিলিয়ন ডলার এবং কেমিক্যাল ও পেট্রোকেমিক্যাল খাতে ১৪১ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য।

শীর্ষ তিন দেশের বাইরে গত অর্থবছর শেষে সিঙ্গাপুরের বিনিয়োগ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ৫৪৭ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশের এফডিআই স্টকের সাত দশমিক ০৮ শতাংশ। দেশটিও বিদ্যুাৎ খাতে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করে। এর পরিমাণ ৩৮৪ মিলিয়ন ডলার। এছাড়া টেলিকম খাতে ২৫৪ মিলিয়ন ডলার, টেক্সটাইল খাতে ১৩৫ মিলিয়ন ডলার এবং কৃষি ও মৎস্য খাতে ৯১ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে।

এর পরের অবস্থানে থাকা দক্ষিণ কোরিয়ার বিনিয়োগ স্থিতি গত অর্থবছর শেষে দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ৪৮৩ বিলিয়ন ডলার বা ৬ দশমিক ৭৯ শতাংশ। দেশটির সর্বোচ্চ বিনিয়োগ টেক্সটাইল খাতে, যা এক বিলিয়ন ডলারের বেশি। এছাড়া চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যে ২০৬ মিলিয়ন ডলার ও ব্যাংক খাতে ১৩৬ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ রয়েছে।

এদিকে নেদারল্যান্ডসের বিনিয়োগ স্থিতি ১ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার বা ৬ দশমিক ০৪ শতাংশ ও হংকংয়ের বিনিয়োগ স্থিতি ১ দশমিক ৩০৯ বিলিয়ন ডলার বা ৫ দশমিক ৯৯ শতাংশ। নেদারল্যান্ডস সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করেছে খাদ্য খাতে ৪৯৮ মিলিয়ন ডলার। এছাড়া বিদ্যুৎ খাতে ১৮৮ মিলিয়ন ডলার ও সিমেন্ট খাতে ১০৩ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ রয়েছে দেশটির। আর হংকং সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করেছে টেক্সটাইল খাতে, ৫৯৪ মিলিয়ন ডলার। এছাড়া বিদ্যুৎ খাতে ১৯৮ মিলিয়ন ডলার ও ব্যাংক খাতে প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ রয়েছে দেশটির।

এর বাইরে বাংলাদেশে এফডিআই স্টক রয়েছে মালেশিয়ার ৮৫১ মিলিয়ন ডলার বা ৩ দশমিক ৮৯ শতাংশ, ভারতের বিনিয়োগ ৬৮৯ মিলিয়ন ডলার বা ৩ দশমিক ১৫ শতাংশ এবং অস্ট্রেলিয়ার বিনিয়োগ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৬৭৭ মিলিয়ন ডলার বা ৩ দশমিক ১০ শতাংশ। এছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) ৪৮৬ মিলিয়ন ডলার ও জাপানের ৪৫৩ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ রয়েছে।

তথ্যমতে, বিদেশিরা বাংলাদেশে পাঁচটি খাতে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করে। এগুলো হলো বিদ্যুৎ, টেক্সটাইল, গ্যাস ও পেট্রোলিয়াম, ব্যাংক এবং টেলিকমিউনিকেশন খাত। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ আসে বিদ্যুৎ খাতে। গত অর্থবছর শেষে এ খাতে বিনিয়োগ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৯৫১ বিলিয়ন ডলার, যা মোট বিনিয়োগের ১৮ দশমিক ১০ শতাংশ। এর পর টেক্সটাইল খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ ৩ দশমিক ৮০৫ বিলিয়ন। এছাড়া গ্যাস ও পেট্রোলিয়াম খাতে ৩ দশমিক ৭৪৫ বিলিয়ন, ব্যাংক খাতে ২ দশমিক ৭৯৩ বিলিয়ন এবং ১ দশমিক ৩১১ বিলিয়ন ডলার টেলিকমিউনিকেশন খাতে। এসব খাতের মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ চীনের, গ্যাসে যুক্তরাষ্ট্রের, টেক্সটাইলে দক্ষিণ কোরিয়ার, ব্যাংকে যুক্তরাজ্যের ও টেলিকমে মালয়েশিয়ার।