প্রথমে একটা গল্প বলা যাক, একজন বালককে প্রথমে বলা হলো ভাত খাও। সে ক্ষুধার চোটে গোগ্রাসে ভাত গিলতে শুরু করল। এরপরই বলা হলো ভাত নয়, রুটি ভালো রুটি খাও। সে ভাত রেখে রুটি খাওয়া শুরু করল। পুনরায় রুটিকে অগ্রাহ্য করে বলা হলো বিরিয়ানি ভালো এটা খাও। সে বিরিয়ানিও খাওয়াও শুরু করল। কিন্তু বিরিয়ানি শেষ না হতেই বলা হলো লও কাচ্চি খাওয়ার সময় এসেছে। এখন কথা হচ্ছে যারা ভাত, রুটি, বিরিয়ানি, কাচ্চি তৈরি করছে তারা তাদের চাহিদা অনুযায়ী তৈরি করছে কিন্তু যে বালক খাচ্ছে তার সময় মতো হচ্ছে না। একটা শেষ হতে না হতেই আরেকটা তার সামনে আসছে। এই বালকটিকে বাংলাদেশ আর ভাত, রুটি, বিরিয়ানি এবং কাচ্চি ৪টা শিল্পবিপ্লব মনে করে একবার ভাবুন আমাদের দেশের কী অবস্থা।
বাংলাদেশ অন্যান্য উন্নত রাষ্ট্রের ন্যায় খুব তাড়াতাড়ি প্রতিটি শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে না পারলেও তাকে খুব শিগগিরই মুখোমুখি হতে হচ্ছে আরেকটি বিপ্লবের। ইংল্যান্ডে ১৭৬০ সালে বাষ্পীয় ইঞ্জিনের আবিষ্কার যে শিল্পবিপ্লব আনয়ন করে তা ওই দেশের জন্য সহজলভ্য এবং সুদূরপ্রসারী বিনিয়োগ ছিল। এরপর ১৮৭০ সালে বিদ্যুতের আবিষ্কার উন্নত রাষ্ট্রগুলোকে পৌঁছে দেয় উন্নতির শীর্ষে। এই বিদ্যুৎ উন্নত রাষ্ট্রগুলোতে অনেক আগেই সহজ থেকে সহজতর হলেও বাংলাদেশের প্রত্যেক গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছালো মাত্র কয়েক বছর হলো।
এরপরই তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের কথা যদি বলা হয় তৃতীয় শিল্পবিপ্লব সংঘটিত হয় ১৯৬০ সালে তথ্যপ্রযুক্তি উদ্ভবের ফলে। এতে বিভিন্ন ভারী ও মাঝারি শিল্পে অভাবনীয় পরিবর্তন ঘটে। তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের মূল প্রভাবক ছিল কম্পিউটার ও ইন্টারনেট প্রযুক্তি এবং ফলাফল ছিল বিভিন্ন শিল্পের অভাবনীয় পরিবর্তন। এই শিল্পের অভাবনীয় পরিবর্তন অন্য দেশে যতটা হয়েছে বাংলাদেশ তার তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে। এমনকি করোনাকালীন আইসিটি যন্ত্রের সহজলভ্যতা না থাকার কারণেই বাংলাদেশ শিক্ষাক্ষেত্রে প্রায় এক বছর পিছিয়ে। যদিও এই এক বছরের লস রিকোভারির জন্য শিক্ষার্থীদের গোগ্রাসে গেলানো হচ্ছে পড়াশোনা। তৃতীয় শিল্পবিপ্লবে খাপ খাওয়ানোর দুর্বল সময়েই শুরু হয়ে গেল চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ডাক।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ধারণাটি ১ এপ্রিল, ২০১৩ সালে জার্মানিতে আনুষ্ঠানিকভাবে উপস্থাপিত হয়। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবটি হবে মূলত ডিজিটাল বিপ্লব। ডিজিটাল বিপ্লবের ফলে কল-কারখানাগুলোয় ব্যাপক হারে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়। যেটা বাংলাদেশেও এক সময় শুরু হবে। যোগাযোগ ব্যবস্থায় আসে আমূল পরিবর্তন। আগের শিল্পবিপ্লবগুলোর ক্ষেত্রে দেখা যায় মানুষ যন্ত্রকে পরিচালনা করছে। কিন্তু চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে যন্ত্রকে উন্নত করা হয়েছে, ফলে যন্ত্র নিজেই নিজেকে পরিচালনা করছে। এই তথ্যগুলো বাংলাদেশের মানুষজন শুধু শুনে চলেছে, প্রত্যক্ষভাবে তারা কবে সেই জায়গায় পৌঁছাবে তা কল্পনা করেই দিন পার করবে অনেকে।
এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রভাবে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ চাকরিচ্যুত হবে। কারণ এ খাতে যন্ত্রের ব্যবহার হবে সবচেয়ে বেশি। অন্যান্য খাতের মধ্যে আসবাবপত্র শিল্পে ৫৫ শতাংশ, প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য শিল্পে ৪০ শতাংশ, চামড়া ও জুতা শিল্পে ৩৫ শতাংশ এবং সেবা শিল্পে ২০ শতাংশ লোক কর্মহীন হয়ে পড়বে। এই বিপুল জনশক্তির কর্মহীনতা দেশের জন্য হুমকি বয়ে আনবে। যদি না বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়।
ডিজিটাল প্রযুক্তির এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তথ্যপ্রযুক্তি ও কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিরাই টিকে থাকবে। অথচ আমাদের দেশে কারিগরি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ জনবল মাত্র ১৪ শতাংশ। কারিগরি শিক্ষার দিকে প্রায় মানুষেরই অনীহা এর মূল কারণ। অথচ উন্নত বিশ্বের দিকে তাকালে দেখা যায়, তাদের কারিগরিভাবে দক্ষ জনগোষ্ঠী প্রায় ৬০ শতাংশ।
তাই আমাদের এখন থেকেই একটি সুপরিকল্পনার মাধ্যমে এগিয়ে যেতে হবে এবং একই সঙ্গে বাংলাদেশে কারিগরি দিক থেকে দক্ষ জনগোষ্ঠী গড়ে তুলতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশের ৬৪টি জেলা ও ৪ হাজার ৫০১টি ইউনিয়ন পরিষদকে ডিজিটাল নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হয়েছে। সরকারের প্রধান সেবাগুলো, বিশেষ করে ভূমি নামজারি, ই-পূর্জি, জš§নিবন্ধন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদন, ভোটার আইডি কার্ড, ই-টিন সার্টিফিকেট ইত্যাদি ডিজিটাল পদ্ধতিতে নাগরিকদের সেবা দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। রোবোটিকস, থ্রিডি টেকনোলজি প্রভৃতির ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়েছে অনেক দেশে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যাপক পরিবর্তনময় পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে নেয়ার মতো করে আগামী প্রজš§কে গড়ে তুলতে শিক্ষা ব্যবস্থায় দরকার সময়োপযোগী শিক্ষা উপকরণ।
মাকসুদা আক্তার
শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়