শেখ আবু তালেব: করোনা মহামারিতে পর্যুদস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধার ও ব্যবসায়ীদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে প্রণোদনার ঋণ প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়, যাতে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হয়। প্রণোদনার এ ঋণের অর্থের পুরোটাই বাস্তবায়ন করা হবে ব্যাংকের মাধ্যমে। কিন্তু সিএমএসএমই খাতে ঋণ বিতরণে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা মানছে না রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক ও বিডিবিএল ব্যাংক।
জানা গেছে, দেশের অর্থনীতিতে কর্মসংস্থানে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে কুটির, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি (সিএমএসএমই) আকারের উদ্যোক্তাদের প্রতিষ্ঠানগুলো। করোনা মহামারিতে এসব প্রতিষ্ঠানকে বাঁচিয়ে রাখতে ২০ হাজার কোটি টাকার ঋণ প্যাকেজ ঘোষণা করেছে সরকার। এ ঋণ বাস্তবায়নে ব্যাংকগুলোকে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
সূত্রে জানা গেছে, গত অক্টোবর পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক ও বিডিবিএল বিতরণ করেছে মাত্র ৪৮০ কোটি টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার ১৬ দশমিক ১৫ শতাংশ। অথচ ব্যাংকগুলোর লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে তিন হাজার কোটি টাকার।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, গত অক্টোবর পর্যন্ত ব্যাংকগুলো এ পরিমাণ ঋণ বিতরণ করেছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় বাণিজ্যিক ব্যাংককে দুই হাজার ৯৭৩ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। এর মধ্যে জনতা ব্যাংকের এক হাজার ৩৭ কোটি টাকার বিপরীতে বিতরণ করেছে ১৯ কোটি ৭০ লাখ টাকা, সোনালী ব্যাংকের ৫৩৭ কোটি টাকার বিপরীতে বিতরণ ১৭৪ কোটি ৬৪ লাখ টাকা, রূপালী ব্যাংকের ২৬৩ কোটি টাকার বিপরীতে বিতরণ মাত্র ৬৩ কোটি টাকা, অগ্রণী ব্যাংকের ৮৪৬ কোটি টাকার বিপরীতে ১৬১ কোটি টাকা ও বেসিক ব্যাংকের ২৭০ কোটি টাকার বিপরীতে ৪৯ কোটি ১৯ লাখ টাকা।
কম ঋণ বিতরণের বিষয়ে অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মাদ শামস্-উল ইসলাম বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি। সব জায়গায় উৎপাদন খাতের উদ্যোক্তা পাওয়া যাচ্ছে না। এটি একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের সামনে, তারপরও চেষ্টা চলছে। মোট লক্ষ্যমাত্রার ৩০ শতাংশ ট্রেডিং খাতে দেওয়া যাবে, যা এতদিন ২০ শতাংশ ছিল। নতুন সিদ্ধান্তে ঋণ বিতরণের হার বৃদ্ধি পাবে।’
জানা গেছে, শতাংশ হিসাবে লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিতরণ বিডিবিএল ব্যাংকের। ২০ কোটি টাকার বিপরীতে গত অক্টোবর পর্যন্ত বিতরণ করেছে ১১ কোটি ৬১ লাখ টাকা, যা মোট লক্ষ্যমাত্রার ৫৮ শতাংশ। সবচেয়ে কম বিতরণ করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক মাত্র এক দশমিক ৯ শতাংশ। এছাড়া অগ্রণী ব্যাংক মোট লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে ১৯ দশমিক ১৩ শতাংশ, বেসিক ব্যাংক ১৮ দশমিক ২২ শতাংশ, রূপালী ব্যাংক ২৩ দশমিক ৯৬ শতাংশ ও সোনালী ব্যাংক ৩২ দশমিক ৫২ শতাংশ ঋণ বিতরণ করেছে।
সামগ্রিকভাবে এই ছয় ব্যাংক মোট লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে মাত্র ১৬ দশমিক ১৫ শতাংশ ঋণ বিতরণ করেছে। ক্ষুদ্রঋণ বিতরণে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর এমন অনাগ্রহ নিয়ে হতাশ বাংলাদেশ ব্যাংক। অর্থ মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়ে নিয়মিত জানানোর পরও কোনো তৎপরতা বাড়াচ্ছে না ব্যাংকগুলো। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে নিয়মিত তাগাদা দেওয়া হচ্ছে ব্যাংকগুলোকে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, ব্যাংকগুলোর হাতে পর্যাপ্ত তারল্য রয়েছে। গ্রামপর্যায়ে রয়েছে বিস্তৃত শাখা। ইচ্ছা করলেই এ ব্যাংকগুলো লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ঋণ বিতরণ করতে পারে। কিন্তু ব্যাংকগুলো এ বিষয়ে তেমন উদ্যোগ নিচ্ছে না। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে ছুটির দিনেও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর বিভাগীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে অনলাইনে বৈঠক করা হচ্ছে।
গত অক্টোবর পর্যন্ত সোনালী ব্যাংকের ১০ হাজার ১৬৬টি, অগ্রণী ব্যাংকের দুই হাজার ৩৭৪টি, জনতা ব্যাংকের ১৯৫টি, রূপালী ব্যাংকের এক হাজার ১২৩টি ও বেসিক ব্যাংকের ৩১১টি ঋণ মঞ্জুর হয়।
গত অক্টোবর পর্যন্ত এ খাতে মোট ছয় হাজার ৬২৭ কোটি ৩৪ লাখ টাকার ঋণ বিতরণ করেছে ব্যাংকগুলো। এর মধ্যে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো তিন হাজার ৩৪৫ কোটি ৯৮ লাখ টাকা ও বিদেশি ব্যাংকগুলো দুই হাজার ২১৫ কোটি ৫১ লাখ টাকা।
জানা গেছে, ঋণ বিতরণে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় প্রচলিত সুদভিত্তিক ব্যাংকগুলোর ১০ হাজার ৫৭৯ কোটি ও ইসলামি ধারার জন্য পাঁচ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এছাড়া বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর জন্য ১৭০ ও বিদেশি ব্যাংকের শাখাগুলোকে ১৯৪ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়।
এ ঋণের সুদহার নির্ধারণ করা হয় ৯ শতাংশ। এর মধ্যে চার শতাংশ পরিশোধ করবে গ্রাহক ও অবশিষ্ট পাঁচ শতাংশ ব্যাংকগুলোকে দেবে সরকার। কিন্তু ব্যাংকগুলো তারপরও ঋণ বিতরণে অনাগ্রহ দেখায়। এতে একপর্যায়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ক্রেডিট রিস্ক গ্যারান্টি স্কিম ঘোষণা করে।