সর্বানন্দ সোনোয়াল: ভারতের নদীগুলো একটি মহান সভ্যতার মূর্ত প্রতীক হয়ে বয়ে চলেছে। এই নদীগুলোর সঙ্গে মানুষের গভীর ও স্থায়ী আধ্যাত্মিক সম্পর্ক রয়েছে। এগুালো লাখো মানুষের জীবিকার উৎস এবং লাখ লাখ প্রজাতির প্রাণবন্ত আবাসস্থল।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দ্বারা জাতীয় নৌপথের উন্নয়নে গুরুত্ব প্রদানের মূল কারণ এই সভ্যতার পরিচয়ের মধ্যে নিহিত। নদীগুলোর ওপর সৃষ্ট জাতীয় নৌপথগুলো হলো সম্ভাব্য অর্থনৈতিক গুণক যা কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারে, পর্যটনকে উৎসাহিত করতে পারে, তীরে স্মার্ট শহর তৈরি করতে পারে, শহরে পরিষ্কার জল সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারে, জলজ জীবনকে লালন-পালন করতে পারে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, শুধু এই অঞ্চল জুড়ে নয়, অন্যান্য দেশেও পণ্য ও জনপরিবহনের জন্য বিকল্প রুটও খুলে দেয়ার মাধ্যমে বাণিজ্য ও পরিবহনকে সমৃদ্ধ করতে পারে।
ভারতের জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে গঙ্গানদীর ওপর নির্ভরশীল। গঙ্গা অববাহিকা বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ নদী অববাহিকাগুলোর মধ্যে একটি যেখানে জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৫২০ জন। কিছু যাত্রা অন্যদের থেকে আলাদা। মুহূর্তের তাৎপর্যের কারণে নয়, বরং তারা ভবিষ্যতের গতিপথ পরিবর্তন করবে বলেই। গত ৫ ফেব্রুয়ারি এমনই এক পরিবর্তনের সূচনা করেছে, যা অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে নতুন দৃশ্যপট উম্মোচন করবে। দিনটিতে ২০০ মেট্রিক টনেরও বেশি খাদ্যশস্য বিহারের পাটনা থেকে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র অতিক্রম করে আসামের পান্ডুর উদ্দেশে যাত্রা করে। এটি ভারতের পণ্য পরিবহন পরিকাঠামোতে একটি পরিবর্তনের সূচনা। ইন্দো-বাংলাদেশ প্রোটোকল রুটের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক জলসীমায় বিশ্বের বৃহত্তম দু’টি নদীতে দুই হাজার ৩৫০ কিলোমিটারের বেশি পথ পাড়ি দিয়ে ব্রহ্মপুত্রে নদে যাওয়ার আগে বঙ্গোপসাগরে একটি বদ্বীপ অতিক্রম করে।
এমভি লাল বাহাদুর শাস্ত্রী নামের জাহাজ এই অভ্যন্তরীণ নৌপথে প্রথম খাদ্যশস্য পরিবহন করবে। এটি পাটনার গাইঘাটের আন্তর্জাতিক নৌ-টার্মিনাল থেকে ফুড করপোরেশন অব ইন্ডিয়ার খাদ্যশস্য বহন করবে। ২৫-৩০ দিনের এই যাত্রাটি জাতীয় নৌপথ-১ (গঙ্গা নদী), নৌপথ-৯৭ (সুন্দরবন), আইবিপি রুট এবং নৌপথ-২ (ব্রহ্মপুত্র নদী) মিলিয়ে একটি সমন্বিত অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল হবে।
পাটনা থেকে গুয়াহাটি যাত্রার সময় জাহাজটি ভাগলপুর, মনিহারি, সাহেবগঞ্জ, ফারাক্কা, ত্রিবেণী, কলকাতা, হলদিয়া, হেমনগর, খুলনা, নারায়ণগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, চিলমারি, ধুবরি ও যোগীঘোপা হয়ে যাবে।
পণ্যবাহী জাহাজ চলাচল এই একাধিক নৌপথ ব্যবহার করে অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল পদ্ধতির প্রযুক্তিগত ও বাণিজ্যিক কার্যকারিতা প্রতিষ্ঠা করবে বলে আশা করা হচ্ছে। অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচলের লক্ষ্য হলো পণ্য পরিবহনের জন্য একটি বিকল্প পথ খোলার মাধ্যমে উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের শিল্প বিকাশে উৎসাহ প্রদান করা।
পাটনা থেকে গুয়াহাটা পর্যন্ত এই নৌ-চলাচলটি প্রধানমন্ত্রী গতি শক্তি জাতীয় মহাপরিকল্পনার একটি উদাহরণ, যার লক্ষ্য প্রতিবন্ধকতা দূর করার মাধ্যমে বিরামহীন পণ্য ও জনপরিবহনের জন্য একটি মাল্টি-মডেল সংযোগ তৈরি করা। অভ্যন্তরীণ জলপথ হলো ভারতকে সংযুক্ত করার সর্বোত্তম, সবচেয়ে পরিবেশবান্ধব ও অর্থনৈতিকভাবে দক্ষ উপায়।
অভ্যন্তরীণ জলপথের গুণক প্রভাব নদীগুলোর দৃশ্যমান উপকূলের বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে। যখন পণ্য ও মানুষ ফেরি বা জাহাজে চলাচল করে, তখন এটি একটি পরিচর্যাকারী ইকোসিস্টেম তৈরি করতেও সাহায্য করে, যা ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন পরিষেবা-চালিত অর্থনৈতিক কার্যকলাপের পরিধি বজায় রাখার পাশাপাশি সিমেন্ট ও স্টিলের মতো মধ্যবর্তী শিল্পগুলোকেও উপকৃত করে।
কারিগরি খরচ কমাতে, ভারতীয় শিল্পকে প্রতিযোগিতামূলক করতে এবং ভারতের অভ্যন্তরীণ নৌপথগুলোকে একটি কার্যকর, উন্নয়নশীল পরিবহন, বিশেষ করে পণ্য পরিবহনের মাধ্যম হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্য রয়েছে মোদি সরকারের। অভ্যন্তরীণ নৌপথের নেটওয়ার্ক নদী, চ্যানেল, বদ্ধ জলাশয় ও খাড়ি মিলে প্রায় ১৫ হাজার কিলোমিটার বিস্তৃত।
গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, এ ধরনের অবকাঠামো সমৃদ্ধির নতুন নতুন দ্বার খুলে দেয়। বিভিন্ন শিল্প এমন এলাকায় কারখানা স্থাপন ও গাছপালা রোপণ করতে পারে যেখানে আগে কার্গো চলাচলের দক্ষ পরিকাঠামোর অভাবের কারণে তা অকার্যকর বলে বিবেচিত হয়েছিল।
ভারতের নদীগুলো এর সভ্যতার স্বাতন্ত্র্যকে রক্ষা করে এসেছে। পণ্য ও জনপরিবহনের জন্য একটি শক্তিশালী, সুসংগঠিত নেটওয়ার্ক হিসেবে জাতীয় নৌপথের বিকাশের উদ্দেশ্য এইগুলোকে ভারতের বিকাশের অন্যতম শক্তিশালী ভিত্তিতে পরিণত করা।
ভারতের কেন্দ্রীয় বন্দর, নৌপরিবহন, নৌপথ ও আয়ুষ মন্ত্রী