বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য কাস্টমসের অবকাঠামোই বড় বাধা

তামাক ও অ্যালকোহল ছাড়া সব ধরনের বাংলাদেশি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দিয়েছে ভারত। ফলে ভারতে পণ্য রফতানিতে শুল্কসংক্রান্ত কোনো বাধা নেই। কিন্তু বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা প্রায়ই বলেন পণ্য রফতানিতে নানা বাধার কথা। এগুলো হলো ‘নন-ট্যারিফ ব্যারিয়ার’ বা অশুল্ক বাধা। বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্যের অশুল্ক বাধার বিষয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের দ্বিতীয় পর্ব আজ

মাসুম বিল্লাহ জাকারিয়া পলাশ : বাংলাদেশ ও ভারতের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অবকাঠামোগত দুর্বলতাকেই সবচেয়ে বড় অশুল্ক বাধা হিসেবে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিষয়টি স্থান পায় জয়েন্ট গ্রুপ অব কাস্টমসের (জেজিসি) বৈঠকসহ বিভিন্ন দ্বিপক্ষীয় আলোচনায়। কিছু ক্ষেত্রে অগ্রগতি হলেও এর মধ্যে রয়েছে নানা অসঙ্গতি। সীমান্তবর্তী হলেও বাণিজ্য ব্যবস্থাপনার অবকাঠামো সরঞ্জাম ও প্রযুক্তির ব্যবহারের ক্ষেত্রে সাম্য আনতে পারেনি। অবশ্য প্রযুক্তি ও নীতিগত সমন্বয়কেই গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

দুই দেশের কাস্টমস পর্যায়ের বিভিন্ন বৈঠকে কয়েক বছর ধরেই এ নিয়ে আলোচনা হয়ে আসছে। ২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত জয়েন্ট গ্রুপ অব কাস্টমসের (জেজিসি) নবম দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে ১৬টি স্থানীয় শুল্ক (এলসি) স্টেশন নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু এসব স্টেশনের মধ্যেও বেশ কয়েকটিতে এখনও গড়ে ওঠেনি বাণিজ্য-সহায়ক অবকাঠামো।

কাস্টমস কর্মকর্তাদের সূত্রে জানা গেছে, ১৬টি এলসির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল সিলেট সীমান্তবর্তী ডলুরা-বালাত এলসি স্টেশন। কিন্তু সেখান থেকে বাণিজ্য কম হওয়ায় এলসি স্টেশনটি বন্ধ হয়ে যায়। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে গত আগস্টে অনুষ্ঠিত জেজিসি বৈঠকে ওই স্টেশনটি চালু করার প্রস্তাব দেওয়া হলেও ভারতীয় পক্ষ তা নাকচ করে দিয়েছে। এ সময় এলসি স্টেশনগুলোতে অবকাঠামো উন্নয়নের বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়।

এদিকে দর্শনা-গেদে সীমান্তেও দুর্বল অবকাঠামোর বিষয়টি বিভিন্ন আলোচনায় উঠে এসেছে। এই স্থলবন্দরটির বর্তমান অবস্থা পর্যালোচনার জন্যও আলোচনা হয় জেজিসির বৈঠকে। এ সময় বলা হয়, সীমান্ত থেকে ভারতীয় প্রান্তে অবস্থিত গেদের রাস্তা খুবই সংকীর্ণ। তাই সেখান থেকেও বাণিজ্য গতিশীল করা সম্ভব হচ্ছে না। এ নিয়ে উভয় পক্ষ অবকাঠামো নির্মাণের বিষয়ে একমত হলেও কার্যত এর গতিশীলতা নিয়ে সংশয় দেখা গেছে।

অবশ্য অবকাঠামো ও প্রযুক্তির ব্যবহারের বিষয়ে দুই দেশ নীতিগতভাবে একমত হলেও এর বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নিয়ে মতৈক্য হয়নি এখনও। ভারতের তরফে ‘অফ-বর্ডার ক্লিয়ারেন্স’ ব্যবস্থার প্রস্তাব করা হয়েছে, যার আওতায় একটি ‘ইলেক্ট্রনিক কার্গো ট্র্যাকিং সিস্টেম (ইসিটিএস)’ ব্যবহারের কথা বলা হয়। এতে ট্রাকের মধ্যে একটি ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ বসানো হবে। ওই যন্ত্রাংশের মাধ্যমে পুরো ট্রাকের পণ্য পরীক্ষা করা সম্ভব হবে বলে ভারতীয় প্রস্তাবে বলা হয়। এতে করে ট্রাকগুলো সীমান্তে লোড-আনলোড না করেই যাতায়াত করতে পারবে। পাশাপাশি দীর্ঘ লাইনের সমস্যা দূর করা সম্ভব হবে। সেপ্টেম্বরের শেষ নাগাদ এ বিষয়ে ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে একটি বিস্তারিত ধারণাপত্র দেওয়ার কথা রয়েছে। এ প্রস্তাব যাচাই-বাছাই করা হবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ। অবশ্য, দর্শনা-গেদে সীমান্তের রাস্তা উন্নয়নের প্রস্তাবেও ইসিটিএস-প্রযুক্তির ব্যবহারকে সমাধান হিসেবে দেখিয়েছে ভারত, যা বাংলাদেশ এখনও চ‚ড়ান্ত করেনি।

এদিকে বিপুল বাণিজ্য হয় এমন বন্দরগুলোতেও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে না। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ এলসি স্টেশনে এখনও ওয়েব্রিজ (লোড হওয়া গাড়ি ওজন করার প্রযুক্তি) নেই। ফলে বিপুল পরিমাণ পণ্য আনলোড করে তা ওজন করতে হচ্ছে। ম্যানুয়ালি এসব কার্যক্রম চালাতে গিয়ে চালানে উল্লেখ করা তথ্যের সঙ্গে পরিমাপে পাওয়া তথ্যের ব্যাপক গড়মিলও দেখা যাচ্ছে। আর এই গড়মিলের কারণে বাধা পাচ্ছে বাণিজ্য।

কাস্টমসসহ অন্যান্য অশুল্ক বাধা নিরসনের বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, অশুল্ক বাধাগুলো খুবই বৈচিত্র্যময়। এসব বাধা নিরসনে দু’দেশের নেতৃস্থানীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক সদিচ্ছা আছে বলে মনে হচ্ছে, কিন্তু এজন্য কিছু অবকাঠামো গড়ে তোলা প্রয়োজন। এজন্য রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দক্ষ মানবসম্পদ, সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার উন্নয়নে বিনিয়োগ করা প্রয়োজন। দুই প্রান্তের কাস্টমস কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ জরুরি। আর ইলেক্ট্রনিক ডেটা আদান-প্রদান বৃদ্ধি, মানুষের ওপর আরোপিত বাধা (কোয়ারান্টাইন) দূর করা ও সিঙ্গেল উইন্ডো ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। এসব বাণিজ্য-সহায়ক ব্যবস্থা (ট্রেড ফেসিলিটেশন মেজারস) নিলে অশুল্ক বাধাগুলো কমে আসবে। কিন্তু বাস্তবে সেগুলো হতে দেখছি না আমরা।

অবশ্য বাংলাদেশে অবস্থিত প্রধান প্রধান এলসি স্টেশনগুলোকে এরই মধ্যে একটি কেন্দ্রীয় অটোমেটিক কাস্টমস ব্যবস্থার (ইডিআই) সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে, কিন্তু ভারতীয় পক্ষের অধিকাংশ এলসি স্টেশনে সে ব্যবস্থা নেই, যদিও ইলেক্ট্রনিক তথ্য আদান-প্রদানের বিষয়ে উভয় পক্ষ একমত হয়েছে। ভারতীয় পক্ষ দাবি করছে, ইডিআই ব্যবস্থা পেট্রাপোলসহ চারটি স্থানে সক্রিয় রয়েছে।

Add Comment

Click here to post a comment

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০