বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন সমস্যা

নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ। সারা দেশে বর্তমানে প্রায় ১ হাজার আটটি নদী রয়েছে। এই নদীগুলোর মধ্যে ৫৭টি হচ্ছে ট্রান্স বাউন্ডারি রিভার বা আন্তঃসীমান্ত নদী যার মধ্যে ৫৪টি বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অভিন্ন এবং ৩টি বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে অভিন্ন। এছাড়াও ট্রান্স বাউন্ডারি রিভার হিসেবে স্বীকৃতি না পাওয়া প্রায় দুইশতাধিক নদী রয়েছে প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে। এসব অভিন্ন নদীর স্বাভাবিক গতিপথ সচল রাখা দুটি দেশের জন্য অত্যন্ত জরুরি।

এসব নদীর অনেকগুলোর উজানে ভারতীয় অংশে ড্যাম ও ব্যারাজ নির্মাণ করে পানির একতরফা নিয়ন্ত্রণ নেয়া হয়েছে। ফলস্বরূপ বাংলাদেশের ভাটি অংশে প্রয়োজনের সময় বিশেষ করে শুকনা মৌসুমে পর্যাপ্ত পানি প্রবাহিত না হওয়ায় কৃষিসহ নানা কর্মকাণ্ড ব্যাহত হয়, তেমনি অতিরিক্ত পানি সামলানোর নামে বর্ষা মৌসুমে বাঁধগুলোর গেট খুলে দেয়ায় ভাটি এলাকা বন্যাকবলিত হয় এবং ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। উজানের দেশে যদি অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হয় এবং পানি ছেড়ে দেয়ার প্রয়োজন হয় তাহলে ভাটির দেশকে আগে থেকেই জানানোর প্রয়োজন হয়। যাতে করে ভাটির দেশের লোকজন নিজেদের প্রস্তুত করতে পারে এবং লোকজনকে সরানো যায়। কিন্তু সম্প্রতি কোনো ধরনের আগাম সতর্কতা ও প্রস্তুতি নেয়ার সুযোগ না দিয়ে ত্রিপুরায় গোমতী নদীর উজানে ডম্বুর বাঁধ খুলে দেয়া হয়েছে। ফলে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের বেশ কয়েকটি জেলায় ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের বহুল আলোচিত বিষয় ফারাক্কা বাঁধ। ১৯৯৬ সালে সম্পাদিত ভারত-বাংলাদেশ চুক্তি অনুযায়ী গঙ্গা নদীতে ৭০ হাজার কিউসেক পানি থাকলে উভয় দেশ পাবে ৩৫ হাজার কিউসেক। আর ৭৫ হাজার কিউসেকের বেশি পানি থাকলে ৪০ হাজার কিউসেক পাবে ভারত, বাকিটা পাবে বাংলাদেশ। ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গা চুক্তিতে পানি বণ্টনের বিষয়টি স্পষ্ট করে বলা থাকলেও সেটি ঠিকমতো মানছে না ভারত। শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গার পানি অন্যায়ভাবে অপসারণের ফলে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এতে বাংলাদেশকে কৃষি, মৎস্য, বনজ, শিল্প, নৌ-পরিবহন, পানি সরবরাহ ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যাপক লোকসানের সম্মুখীন হতে হয়। প্রত্যক্ষভাবে বাংলাদেশের প্রায় ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার ক্ষতি হয়।
তিস্তা দেশের উত্তরাঞ্চলের কৃষি, মৎস্য ও খাদ্য ব্যবস্থার জন্য পানির বড় আধার।

বিশেষ করে অববাহিকাসংলগ্ন প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার গ্রামের মানুষ তাদের জীবিকার জন্য এ নদীর ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। তিস্তার ওপর নির্ভরশীল ৭০ ভাগ লোক বাংলাদেশে তিস্তার অববাহিকায় বসবাস করে। তাই আমাদের জন্য তিস্তার পানি বণ্টনের গুরুত্ব অনেক বেশি। মাঝে মধ্যে লালমনিরহাটের ডালিয়া পয়েন্টে পানির প্রবাহ কমে দাঁড়ায় ৫০০ কিউসেক। অথচ নদী রক্ষায় প্রয়োজন ১ হাজার কিউসেক। আবার সেচ প্রকল্পের জন্য ন্যূনতম ৩ হাজার কিউসেক পানি প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক আইনি বিধি ব্যবস্থা অনুযায়ী একটি আন্তঃদেশীয় নদী হিসেবে তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা পাওয়া বাংলাদেশের অধিকার। আমাদের এই অধিকার যদি নিশ্চিত না হয় তাহলে তা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে প্রভাব ফেলতে বাধ্য।

নদীমাতৃক বাংলাদেশকে একসময় তেরোশ’ নদীর দেশ বলা হতো। আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে উজানের দেশ ভারতের অংশে বাঁধ নির্মাণের ফলে অনেকগুলো নদীর অস্তিত্ব বিলীন গেছে। ১৯৭২ সালের মার্চে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে যৌথ নদী কমিশন (জেআরসি) গঠন হয়। দুঃখজনক হলো, এ কমিশন দীর্ঘ ৫২ বছরেও পানিবণ্টনে কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। ১৯৯৭ সালে আন্তর্জাতিক পানিপ্রবাহ কনভেনশনটি ২০১৪ সালের ১৭ আগস্ট থেকে আইনে পরিণত হয়েছে। সেখানে উজানের দেশ থেকে ভাটির দেশে প্রবাহিত নদীর পানি কীভাবে ব্যবহƒত হবে, তার দিকনির্দেশনা আছে। যে নদীর পানি যে খাতে প্রবাহিত হয়, সেই নদীর পানি সেই খাতে না রেখে খাত পরিবর্তন করলে তা নদীর জন্য কল্যাণের হবে না। কিন্তু দুঃখজনক যে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে এতে অংশ নিতে পারেনি। অনুসমর্থন করে জাতিসংঘে এই কনভেনশনের আলোকে প্রতিকার চাওয়ার সুযোগ আছে। দ্বিপাক্ষিকভাবে এই সমস্যা সমাধান না হওয়ার এখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা নেয়া সময়ের দাবি।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০