জাকারিয়া পলাশ: বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা আরিফুল হক। ছয় বছরের ছেলের জন্য ঈদের আগে সাইকেল কেনার জন্য গেলেন নিউমার্কেটে। চীনের তৈরি একটি ব্র্যান্ডের সাইকেলের দাম চাওয়া হলো ১০ হাজার টাকা। এত দাম শুনে কিছুটা হতাশ হয়ে পরামর্শ চাইলেন সহকর্মী ফাহিমুল ইসলামের কাছে। তার পরামর্শে তিনি বাইসাইকেল কিনতে গেলেন পুরান ঢাকার বংশালে। একই ব্র্যান্ডের সাইকেলটি কিনলেন মাত্র ৬ হাজার টাকায়।
দামের এতটা ভিন্নতার কারণ জানতে চাইলে বিক্রেতা মো. হানিফ জানান, ‘নিউমার্কেটে সাইকেলের দোকান কম। ফলে সেখানে প্রতিযোগিতাও নেই। আর দোকান ভাড়াসহ অন্যান্য খরচ বেশি হওয়ায় সেখানে দাম অনেক বেশি পড়ে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের বাজারে সিংহভাগ বাইসাইকেল আমদানি হয় চীন ও ভারত থেকে। চার-পাঁচটি দেশি কোম্পানি বাইসাইকেল প্রস্তুত করলেও তা স্থানীয় বাজারে বিক্রি হয় না। দেশি কোম্পানিগুলোর পণ্য প্রধানত ইউরোপের কোটাসমৃদ্ধ বাজারে যায়। ফলে দেশের বাজারে চাহিদা পূরণের জন্য আমদানিই প্রধান ভরসা। আর আমদানিকৃত বাইসাইকেলের মূল বাজারটি গড়ে উঠেছে পুরান ঢাকার বংশালে।
পূর্ণাঙ্গ বাইসাইকেলের পাশাপাশি সেখানে রয়েছে সাইকেলের যন্ত্রাংশের খুচরা ও পাইকারি বাজার। পুরান ঢাকার বংশাল রোড ও কাজী আলাউদ্দিন রোডে এসব সাইকেলের দোকান ঘুরে দেখা গেছে বিভিন্ন সাইজ ও স্টাইলের প্রায় সব ধরনের বাইসাইকেল মিলছে সেখানে। সেখানে সাধারণ সাইকেলের পাশাপাশি রেসিং সাইকেল, উঁচু গুণগত মান সম্পন্ন ফাইবার ম্যাটেরিয়াল দিয়ে তৈরি হাল্কা ও মজবুত এমটিবি (মাউন্টেইন) সাইকেল পাওয়া যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রায় দুই শতাধিক ছোট-বড় শো-রুম ও বিক্রয় কেন্দ্র আছে বংশালে। তবে ওই সব দোকানের সবাই আমদানিকারক নন। সব মিলে ২৫ জনের মতো আমদানিকারক রয়েছেন, যারা চীন ও ভারত থেকে বাইসাইকেল আমদানি করেন। এদের মধ্যে শীর্ষ আমদানিকারক হচ্ছে সিরাজ সাইকেল। দেশে আমদানিকৃত সাইকেলের প্রায় অর্ধেকই আমদানি হয় সিরাজ সাইকেলের মাধ্যমে। এ ছাড়া অন্য আমদানিকারকরা সম্মিলিতভাবে সাইকেল আমদানি করে থাকেন।
আমদানিকারকরা জানান, সবসময়ই তারা ওইসব দেশ থেকে বাইসাইকেলের যন্ত্রাংশ আমদানি করেন। অতিরিক্ত শুল্কের কারণে তারা সম্পূর্ণ ফিটিং (পূর্ণাঙ্গ) বাইসাইকেল আমদানি করেন না। সাধারণত পূর্ণাঙ্গ সাইকেলের মূল্যের ওপর প্রায় ৮০ শতাংশেরও বেশি শুল্ক আরোপিত হয়। তবে, বিভিন্ন যন্ত্রাংশের ওপর শুল্ক কম থাকে। এজন্য ভাগে ভাগে যন্ত্রাংশ হিসেবেই আমদানি হয় বাইসাইকেল।
বংশালের বাইসাইকেল মিস্ত্রি শহিদুল ইসলাম জানান, ‘একেকটা বাইসাইকেলে বল-বিয়ারিং, নিউম্যাটিক টায়ার, স্পোকেট, রিংসহ প্রায় ১৩৬টি ভিন্ন ভিন্ন যন্ত্রাংশ রয়েছে। এগুলো সাধারণত দুই-তিন ভাগে আলাদা আলাদাভাবে আমদানি করা হয়। পরে বংশালের বিভিন্ন গোডাউনে সেগুলো অ্যাসেম্বেল করা হয়।’
এসব যন্ত্রাংশ আমদানির ক্ষেত্রে কেজিপ্রতি শুল্ক পরিশোধ করতে হয় বলে জানান ব্যবসায়ীরা। এক ব্যবসায়ী জানান, ‘শুল্ক বেশি দিতে হয় বলে আমাদের দেশের বাজারে বাইসাইকেলের দাম বেশি।’ তবে সম্প্রতি কেজি প্রতি শুল্ক দুই ডলার থেকে কমিয়ে দেড় ডলার করা হয়েছে। এতে কিছুটা সুবিধা হয়েছে বলেও তারা জানান।
কাজী আলাউদ্দিন রোডের বিক্রয় কেন্দ্র সাইকেল প্লানেটের মালিক মো. সোহেল শেয়ার বিজকে জানান, এখানে শিশুদের সাইকেলগুলো তিন হাজার থেকে শুরু করে ছয়-সাত হাজার টাকার মধ্যে পাওয়া যায়। আর বড়দের সাইকেলের মূল্য ছয় হাজার টাকা থেকে শুরু করে ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত। উন্নতমানের এমটিবির মূল্য অবশ্য এক লাখ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। রেস কিংবা শৌখিন সাইকেল চালকদের জন্য হাইড্রোলিক ব্রেক ও গিয়ার বিশিষ্ট উন্নত সাইকেলও পাওয়া যাচ্ছে বিভিন্ন মানের ও দামের।
আমদানিকৃত বাইসাইকেল অ্যাসেম্বেলিংয়ের জন্য বেশ কয়েকজন মিস্ত্রি রয়েছেন বংশালে। ওই সব মিস্ত্রি প্রতিটি সাইকেল অ্যাসেম্বল করতে ১২০ থেকে ১৫০ টাকা করে নেন।
এদিকে বাইসাইকেলের বাজারে ব্যতিক্রম হচ্ছে আরএফএল। দুরন্ত বাইসাইকেল নামের আরএফএলের ব্র্যান্ডটি একই সঙ্গে রফতানি ও দেশের বাজার দখলের চেষ্টা করছে। বংশালের প্রায় সব দোকানেই চীন ও ভারতের আমদানিকৃত বাইসাইকেলের পাশাপাশি রয়েছে ‘দুরন্ত’ ব্র্যান্ডের সাইকেল।
সংশ্লিষ্টরা জানান, শুধু দুই চাকার সাইকেলই নয়, তিন চাকার রিকশা-ভ্যানের যন্ত্রাংশের সর্ববৃহৎ বাজার হচ্ছে বংশালে। একটি সূত্রের তথ্যমতে, দেশে আনুমানিক ৮০ লাখ রিকশা ও ভ্যান চলছে। এর পাশাপাশি তরুণ প্রজšে§র কাছে শৌখিন সাইকেলের জনপ্রিয়তাও বাড়ছে দিন দিন। বিশাল এ বাজারের চাহিদা মেটাতে বংশালের উদ্যোক্তারা বড় ভূমিকা রাখছেন বলে দাবি করেন তারা।
উল্লেখ্য, আমদানিনির্ভর স্থানীয় বাজারের বিপরীতে দেশ থেকে ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে প্রায় ২৪৫ লাখ ডলারের বাইসাইকেল রফতানি হয়। দেশের জাহাজভাঙা শিল্পের কাঁচামাল নিয়ে এসব সাইকেল উৎপাদন করে স্থানীয় কোম্পানিগুলো। রফতানিমুখী ওইসব কোম্পানির মধ্যে আরএফএল ছাড়া কেউই স্থানীয় বাজারে নেই।