বাকৃবিতে বেপরোয়া ছাত্রলীগ, নিশ্চুপ প্রশাসন

প্রতিনিধি, বাকৃবি : ক্যাম্পাসজুড়ে বেপরোয়া কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) শাখা ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মী। কিন্তু এ বিষয়ে নিশ্চুপ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ফলে একের পর এক সংঘাতের শিকার হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, সাংবাদিক এবং কর্মকর্তা-কর্মচারী। ছাত্রলীগের এসব কর্মকাণ্ডে ক্যাম্পাসের স্বাভাবিক শিক্ষার পরিবেশ ব্যাহত হচ্ছে বলেও অভিযোগ শিক্ষার্থীদের। বিচারবহির্ভূত এমন ধারাবাহিক ঘটনায় ছাত্রলীগ কর্মীদের অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।

বিশ^বিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) শাখা ছাত্রলীগের ১৯ সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয় গত ২৯ এপ্রিল। কমিটির সভাপতি হন খন্দকার তায়েফুর রহমান রিয়াদ এবং সাধারণ সম্পাদক হন মো. মেহেদী হাসান। এরপরই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ৯টি হলের ৫টি সভাপতি ও অপর ৪টি সম্পাদক নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেন। অর্থাৎ দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায় ছাত্রদের আবাসিক হলগুলো। এ ছাড়া ছাত্রীদের ৪টি হলেও ছাত্রলীগের দুটি ভাগ রয়েছে।

জানা যায়, নতুন কমিটি হওয়ার পরপরই ঘটে বেশকিছু অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা। গত ৩০ মে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হল ছাত্রলীগের সাবেক দপ্তর সম্পাদক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি অনুষদের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মুইন নাদিম আল মুন্নাকে হল থেকে বের করে দেয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে অন্তত ৫০ জন আহত হন। ওই মারামারিতে লাঠিসোটা, রড, স্টাম্পসহ দেশীয় অন্যান্য অস্ত্র ব্যবহার করতে দেখা যায়। ওই ঘটনায় পুরো ক্যাম্পাসে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পরদিন ৩১ মে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তাজনিত কারণে বিশ^বিদ্যালয়ের সব অনুষদের পরীক্ষা বন্ধ করা হয়।

পরবর্তীতে গত ১০ মে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ইসরাত জাহান রিজা (সভাপতি তায়েফুর রহমান রিয়াদ সমর্থক) বেগম রোকেয়া হলের তালা ভেঙে মূল ভবনের ৩০৩ নং কক্ষ জোরপূর্বক দখল এবং ওই কক্ষে থাকা সুরাইয়া আকতার আঁখি নামের এক শিক্ষার্থীকে বের করে দেন। এর প্রতিবাদে আঁখি আরও কয়েকজন ছাত্রীকে নিয়ে ওইদিন মধ্যরাত পর্যন্ত হলের বাইরে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন। এর নেতৃত্ব দেন ছাত্রলীগের সম্পাদক মেহেদী হাসান গ্রুপের নেত্রী তানজিলা শিকদার প্রিয়া। এরপর ১ জুন আবার ইসরাত জাহান রিজা ওই হলের বর্ধিতাংশ ভবন থেকে মূল ভবনের একটি কক্ষে দুজন ছাত্রীকে প্রভোস্টের অনুমতিক্রমে তুলে দিতে চাইলে তানজিলা শিকদার প্রিয়া বাধা দেন। এর প্রতিবাদে রিজা ও তার সমর্থকরা হলের সামনের রাস্তা অবরোধ করেন। বিশ^বিদ্যালয়ের বেগম রোকেয়া হলের কক্ষ দখলকে কেন্দ্র করে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক গ্রুপের ওই দুই নেত্রীর মধ্যে বাগ্্বিত-া ও হাতাহাতির মতো ঘটনাও ঘটে।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে আরও জানা যায়, গত বৃহস্পতিবার (২৫ আগস্ট) নূরুল আমিন নামে এক নিরাপত্তাকর্মীকে বেধড়ক মারধর করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্রলীগ কর্মী। পরে আহত অবস্থায় তাকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরবর্তীতে চতুর্থ শ্রেণি কর্মচারী পরিষদের সিদ্ধান্তে নিরাপত্তা কর্মীরা কর্মবিরতি পালন করেন। এ ঘটনার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মহির উদ্দীন বিষয়টি মীমাংসার প্রতিশ্রুতি দিলে তারা কর্মবিরতি বাতিল করেন। ওই ঘটনার বিষয়ে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছে।
এদিকে গত শনিবার (২৭ আগস্ট) বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহজালাল হলে র‌্যাগিংয়ের ঘটনা সমাধান করতে গিয়ে ছাত্রলীগের ওই হলের নেতাকর্মীর হাতে লাঞ্ছিত ও অবরুদ্ধের শিকার হয়েছেন বিশ^বিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর ড. মো. রিজওয়ানুল হক।

ওই ঘটনার সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের হেনস্তা ও পরে পরিকল্পিত হামলার শিকার হয়েছেন ক্যাম্পাসে কর্মরত সাংবাদিকরা। হামলার শিকার চার সাংবাদিক হলেন ঢাকা পোস্টের বাকৃবি প্রতিনিধি মুসাদ্দিকুল ইসলাম তানভীর, দৈনিক খোলাকাগজ-এর বাকৃবি প্রতিনিধি ইফতেখারুল ইসলাম সৈকত, ডেইলি এশিয়ার এজের বাকৃবি প্রতিনিধি আতিকুর রহমান এবং ক্যাম্পাস লাইভ ২৪ ডটকমের বাকৃবি প্রতিনিধি রায়হান আবিদ।

এছাড়াও কমিটি গঠনের পূর্বে গত ২৬ মার্চে ছাত্রী লাঞ্ছনার ঘটনায় সিসিটিভি ফুটেজ চেয়ে ২৮ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা শাখায় বিক্ষোভ করে ছাত্রলীগের এক পক্ষ। বিক্ষোভের একপর্যায়ে নিরাপত্তা শাখার উভয় পাশের রাস্তা বন্ধ করে দেন আন্দোলনকারীরা। এ সময় একটি প্রাইভেট কার ভাঙচুর করা হয় এবং চালকসহ গাড়ির যাত্রীদের মারধর করা হয়। ওই সময় পেশাগত দায়িত্বে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত সাংবাদিক ওমর আসিফের মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে তাকেও মারধর করেন ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী। ওই ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। পরে তদন্ত প্রতিবেদন জমা পড়ে। কিন্তু পরবর্তীতে আর কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসনকে।

তার কিছুদিন আগে ৮ ফেব্রুয়ারি রাতে রুম দখল করা নিয়ে শাহজালাল হলের আবাসিক বিদেশি শিক্ষার্থীদের সাথে চড়াও হন ওই হলের ছাত্রলীগ কর্মীরা। এ ঘটনার এক পর্যায়ে বিদেশি শিক্ষার্থীদের মারতে উদ্যত হন তারা। ওই ঘটনায়ও কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি বাকৃবি প্রশাসনকে।
জানা যায়, বছরজুড়ে এমন বেশ কয়েকটি অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটলেও একটিরও বিচার হয়নি এ পর্যন্ত। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নীরব ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। প্রতিটি ঘটনার পর বিচারের দাবি জানালে প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়, কিন্তু এরপর আর বিচারের মুখ দেখেনি কোনো ঘটনাই।

এ বিষয়ে ছাত্রলীগ সভাপতি তায়েফুর রহমান রিয়াদ বলেন, সব ঘটনাই অনাকাক্সিক্ষত। ঘটনাগুলোতে ছাত্রলীগের যারা জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এ বিষয়ে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মো. মেহেদী হাসান বলেন, কমিটি গঠনের পর যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, সেগুলো অনাকাক্সিক্ষত। গত শনিবার সাংবাদিকদের সাথে যে ঘটনা ঘটেছে, তার জন্য আমি শাহজালাল হলের নেতাকর্মীদের সাথে বসেছি। ওই ঘটনায় জড়িত কেউ ছাত্রলীগের পদপ্রাপ্ত হয়ে থাকলে তাদের পদ বাতিল করা হবে।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর ড. মুহাম্মদ মহির উদ্দীন বলেন, প্রক্টরের আগে আমি একজন শিক্ষক। সব বিষয় সব সময় মাথায় নিয়ে ঘোরা যায় না। আমি সবগুলো ঘটনার বিষয় সঠিকভাবে জানার পর বলতে পারব। আগামীকাল অফিসে এলে আমি বিষয়গুলো পরিষ্কারভাবে বলতে পারব।
এ বিষয়ে বাকৃবির ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. রফিকুল ইসলাম-১ বলেন, আমি উপাচার্যের রুটিন দায়িত্ব পালন করছি। আগের ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদনগুলো জমা দিয়েছে কমিটি। কিন্তু সেগুলোর বাস্তবায়ন আমার দায়িত্বের বাইরে। উপাচার্য অধ্যাপক ড. লুৎফুল হাসান ছুটি শেষে এলে সব বিষয় তাকে জানানো হবে। পরে সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০