Print Date & Time : 21 June 2025 Saturday 10:56 pm

বাঘ সিংহ ও জেব্রার কাছাকাছি

মো. ইমরান হোসেন: যানজট আর পেশাগত ব্যস্ততা শহুরে জীবনকে অক্টোপাসের মতো বেঁধে রেখেছে। কাকডাকা ভোরে সূর্য উঁকি দিতেই কাজের তালিকা নিয়ে সময়ের অক্টোপাস যেন সামনে হাজির হয়। মনে করিয়ে দেয় কড়া নিয়মকানুন। তারপর সেই চিরচেনা রাজধানীর যানজট। অনেকটা সময় রাস্তায় কাটিয়ে কাজের ব্যস্ততা শুরু হয়। এ রুটিন জীবনকে তাঁতিয়ে তুলেছে। বারবার মনে হচ্ছিল, ছুটে যাই পাহাড়ের পাদদেশে, না হলে সমুদ্রের গর্জন শুনতে। সবুজ অরণ্য আর সমুদ্রের ঢেউ আমাকে খুব ডাকে। কিন্তু উপায় নেই, ফুরসত মেলে না। তা ছাড়া একা একা ঘুরতে ভালোই লাগে না। বন্ধুদের ছুটির সঙ্গে মেলেও না অনেক সময়।

তবু একটু সময় বের করে ফেলি আমি, কাকু আরিফুল ইসলাম আর বড় ভাই পিন্টু মোল্লা। তাদের মতামত অনুযায়ী রাজধানীর কাছাকাছি কোথাও থেকে ঘুরে আসার পরিকল্পনা করি। আসলে এ ব্যস্তময় জীবনে ভ্রমণের কথা শুনলে মনটা চাঙা হয়ে যায়। ঠিক করলাম, ঢাকার কাছাকাছি বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক থেকে ঘুরে আসবো। একদিনেই ঘুরে আসতে পারবো।

৪ আগস্ট ২০১৭, শুক্রবার সকালটি ছিল অন্যদিনের চেয়ে আলাদা। সেদিন কাকের কর্কশ কণ্ঠে ঘুম ভাঙলো না। কাকু আর পিন্টুর দরজার টোকাতে ঘুম ভেঙে যায়। ওরা নারায়ণগঞ্জ থেকে চলে এসেছে।

দ্রুত প্রস্তুত হয়ে যাই। আমাদের সঙ্গে দুই বন্ধু জাবেদ হোসেন শীতল ও মো. অপুও যোগ দেন। একসঙ্গে পাঁচজন, বুঝতে পারছি ভ্রমণটা অনেক মজার হবে। যাতায়াতের জন্য কারো পছন্দ ট্রেন, কারো গাড়ি। অনেক দিন ট্রেনে ওঠা হয় না। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম ট্রেনেই যাবো।

সকাল ৯টার মধ্যে আমরা কমলাপুর রেল স্টেশনে পৌঁছাই। গাজীপুর যেতে হলে জয়দেবপুর রেল স্টেশনে নামতে হবে। ১০টা ১৫ মিনিটে ছেড়ে যায় আমাদের ডেমু ট্রেন। সামনের দিকে এগোচ্ছে ট্রেন, আর আমাদের কৌতূহল বাড়তে থাকে। সাফারি পার্কের কথা এতদিন শুধু শুনেছি, আজ দেখবো। তাই চিন্তা ও মজা করতে করতে আমরা জয়দেবপুর স্টেশনে হাজির হয়ে যাই। এখান থেকে অটোরিকশায় গাজীপুর চৌরাস্তা পৌঁছাই। গাজীপুর শহর থেকে অনেক দূরে বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক। সরাসরি কোনো বাস চলাচল করে না এ রুটে। তাই লেগুনায় চড়ে বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে চলে আসি।

Safari-2ইতোমধ্যে সকালের সূর্যটা মাথার ওপরে চলে এসেছে। প্রখর রোদ। বেশ গরম। পার্কে প্রবেশের আগে দুপুরের খাবার খেয়ে নিই। এরপর টিকিট কেটে ঢুকে পড়ি। গেটের দুপাশে বড় বড় হাতির মূর্তি। ভেতরে ঢুকেই দেখি, একটি বিলবোর্ডে পার্কটির কোথায় কী রয়েছে, কী পাওয়া যাবে এমন সব তথ্য উল্লেখ করা রয়েছে। জানতে পারি, গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মাওনা ইউনিয়নের বড় রাথুরা মৌজা ও সদর উপজেলার পীরুজালী ইউনিয়নের পীরুজালী মৌজার খণ্ড খণ্ড শাল বনের ৪৯০৯ একর ভূমি বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর নিরাপদ আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক। পার্কটি কোর সাফারি, সাফারি কিংডম, বায়োডাইভার্সিটি পার্ক, এক্সটেনসিভ এশিয়ান সাফারি পার্ক ও বঙ্গবন্ধু স্কয়ারÑএ পাঁচটি ভাগে বিভক্ত।

এবার ঘুরে বেড়ানোর পালা। এত বড় পার্কের সবকিছু একদিনে ঘুরে দেখা সম্ভব না। তাই যতটুকু সম্ভব দেখার চেষ্টা করছি।

প্রথমে চলে যাই সাফারি কিংডমে। এখানে ঢুকতেই চোখে পড়লো ম্যাকাওল্যান্ড। আফ্রিকা থেকে আনা নীল-সোনালি ও সবুজ ম্যাকাও, আফ্রিকান গ্রে প্যারোট, টিয়া, পেলিকেন, লুটিনো রিংনেক প্যারোটসহ প্রায় ৩৪ প্রজাতির পাখি রয়েছে। ম্যাকাওল্যান্ডের পাশেই ২০ প্রজাতির মাছের মেরিন অ্যাকুয়ারিয়াম রয়েছে। ক্রোকোডিল ফিস, টাইগার ফিস, ব্ল্যাক গোস, অস্কার প্রভৃতি দেখতে পাই। রয়েছে চিকলেট মাছ, যা ২০ সেকেন্ড পর পর রং পরিবর্তন করে। এখানে আরও আছে প্রজাপতি সাফারি। প্রায় ২৬ প্রজাতির প্রজাপতি রয়েছে। সাফারি কিংডমে রয়েছে প্রকৃতিবীক্ষণ কেন্দ্র, ফ্যান্সি কার্প গার্ডেন, জিরাফ ফিডিং স্পট, আইল্যান্ড, বোটিং ও লেক জোন। তা ছাড়া অর্কিড হাউজ, শকুন ও পেঁচা কর্নার, এগ ওয়ার্ল্ড, ক্যাঙারু ও হাতি শো গ্যালারিও দেখতে পাই আমরা। এখানে আলাদাভাবে নির্মাণ করা হয়েছে বিশাল তিনটি পাখিশালা। ধনেশ পাখিশালায় রয়েছে প্রায় আট প্রজাতির পাখি। এর মধ্যে বিভিন্ন প্রজাতির টিয়া, পিজেন্ট ধনেশ, ফ্লেমিংগো, ব্ল্যাক সোয়ান ও বিরল প্রজাতির মান্ডারিন ডাক ছাড়া হয়েছে। রয়েছে কুমিরের আবাসস্থল। এর পাশে রয়েছে অজগরের আস্তানা। বড় বড় অজগর সাপ যেন নিজেরাই আস্তানা গড়ে নিয়েছে। এক পাশে রয়েছে বানরের খাঁচা। কয়েকটি বানর খাঁচা থেকে লুকিয়ে বের হয়ে খেলায় মেতেছে মানুষের সঙ্গে। সব মিলিয়ে এক অপূর্ব পরিবেশ। এতসব ঘুরে দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। দুপুরের সূর্য পশ্চিমের দিকে হেলে পড়েছে।

এরপর গেলাম ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে। এখানে প্রায় ২০০০ প্রজাতির মেরুদণ্ডী ও অমেরুদণ্ডী প্রাণীর দেহাবশেষ, স্পেসিমেন ও স্টাফিং সংরক্ষিত রয়েছে। প্রায় ৩০০ প্রজাতির গাছের হারবেরিয়াম সিড জাদুঘরটিতে সংরক্ষণ করা হয়েছে।

আর ঘুরতে পারছি না। ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। অথচ কোর সাফারি দেখার ইচ্ছে রয়েছে আমাদের। কোর সাফারির কারণেই এ পার্কের এত সুনাম। তাই কষ্ট হলেও লম্বা লাইন ধরে টিকিট সংগ্রহ করলাম। প্রায় ৪৫ মিনিট লাইনে দাঁড়িয়ে অবশেষে গাড়ির দেখা পেলাম। বলে রাখা ভালো, এখানে গাড়ি ছাড়া কোনো পর্যটক প্রবেশ করতে পারে না। দর্শনার্থীদের জন্য রয়েছে জিপ ও মিনিবাস।

কোর সাফারি পার্কে বাঘ, সিংহ, জেব্রা, জিরাফ, অরিক্স, ব্ল্যাক বাক, কালো ভালুক, আফ্রিকান চিতা, সাম্বার, গয়াল, হাতি, চিত্রা, মায়া ও প্যারা হরিণ আছে। আমাদের গাড়ি শ্লথগতিতে বনের ভেতরে প্রবেশ করছে। গা ছমছম করছে কাছে থেকে বাঘ বা সিংহ দেখার জন্য। মুহূর্তগুলো ধরে রাখার জন্য সঙ্গে রয়েছে মোবাইল ফোনের ক্যামেরা। গাড়িটি প্রথমে জেব্রা ও জিরাফের এরিয়ায় ঢোকে। কয়েকটি জিরাফ গলা লম্বা করে দাড়িয়ে আছে। ভালোভাবে দেখানোর জন্য ড্রাইভার গাড়ি থামালো। সবাই এত কাছ থেকে জিরাফ দেখতে পেয়ে উত্তেজিত হয়ে পড়ি। সমস্বরে চিৎকার করি আমরা। আবারও চলতে শুরু করে গাড়ি। এবার ভালুকের বাসস্থান। দেখতে পাই, দূরে কয়েকটি ভালুক খেলা করছে। এরপর চোখে পড়লো সাদা সিংহ। কি যেন খাচ্ছে। সাদা সিংহ আগে কখনও দেখিনি। এবার কিছুদূর এগোতেই দেখি কয়েকটি সিংহ দলবেঁধে আমাদের গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে মনে হচ্ছিল, খুব ক্ষুধার্ত প্রাণীগুলো। আমরা একের পর এক ছবি তুলে যাই। এতদিন শুধু খাঁচার ভেতরে সিংহ, বাঘ, ভাল্লুক দেখেছি। মনে হচ্ছিল আজ আমরা বন্দি, সিংহ আমাদের দেখছে। আরও মনে হচ্ছিল, আমরা বাংলাদেশ ছেড়ে বহুদূরে আফ্রিকার কোনো জঙ্গলে এসে পড়েছি। কিছুক্ষণ পর রাস্তা ছেড়ে গাড়ির পাশ দিয়ে চলে গেলো সিংহের দলটি। গাড়ি আবার চলতে শুরু করলো। এবার ঢুকলাম বাঘের আস্তানায়। দেখি পানিতে অর্ধেক ভিজিয়ে শুয়ে আছে কয়েকটি বাঘ। অদূরে দুই একটা ঘোরাঘুরি করছে। ১৫-২০ মিনিট ঘুরিয়ে গাড়িটি গন্তব্যস্থলে পৌঁছে গেল। নেমে পড়ি গাড়ি থেকে।

সূর্যটাও ইতোমধ্যে বিদায় নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমাদেরও ফেরার পালা। জানি সবকিছু দেখা হয়নি। সবকিছু দেখার জন্য আরও সকালে আসতে হবে। তাই সিদ্ধান্ত নিই, সময় পেলে আবারও ছুটে আসবো সাফারি পার্কে।