Print Date & Time : 17 June 2025 Tuesday 2:34 am

বাঙালির একুশ একুশে বাঙালি

ভারতবর্ষ বিভক্তির পর প্রথম যখন বাংলা ভাষার ওপর আক্রমণ করে পাকিস্তানি অপশক্তি তখন বাংলার দেশপ্রেমিক মানুষ নীরবতা পালন না করে প্রতিবাদ শুরু করে, প্রতিক্রিয়া জানায়।

মাতৃভাষার জন্য যারা এত আন্দোলন সংগঠিত করল, সংগ্রাম চালাল, তারুণ্যের রক্তে রঞ্জিত করল রাজপথ এবং পরিশেষে যারা জীবনদানের মধ্য দিয়ে রক্ষা করল মাতৃভাষা, তাদের আমরা প্রত্যেক বছর একুশে ফেব্রুয়ারি শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করি, শহিদদের সম্মান জানানোর জন্য শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করি। মাতৃভাষা আন্দোলন সফলতার একাত্তর বছরে এসে কি আমরা সর্বোত্ত বাংলা ভাষার ব্যবহার শিখেছি? না, শিখেনি। দেশের অভিজাত হোটেল-রেস্তোরাঁর মতো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে শিল্পকারখানা মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর নামের সাইনবোর্ডের দিকে তাকালেই সেটা স্পষ্টভাবে বুঝার অপেক্ষা রাখে না বাংলার অক্ষরের বিপরীতে ইংরেজি অক্ষরে লেখা। আমাদের ব্যবহার করা যানবাহনগুলোর ফলক নম্বর প্লেটের দিকে তাকালেও তাই দেখা যায়। অভিজাত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর নাম ইংরেজিতে না লিখলে মনে হয় তাদের ব্যবসা একেবারে চলবে না কিংবা হিসাব চুকিয়ে ব্যবসা ছেড়ে বাসায় বসে থাকতে হবে। মাতৃভাষা আন্দোলনের একাত্তর বছরে এসেও কেন আমরা আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম বাংলায় লিখতে অনিচ্ছুক? তবে কি মাতৃভাষা আন্দোলনে রফিক, শফিক, জব্বার, বরকতের মতোর ভাষাসৈনিকদের জীবনদানের কোনো মূল্য নেই? আর কত বছর পার করার পর শহিদদের সম্মানাত্বে সর্বস্তরে বাংলা অক্ষরের চর্চা শুরু করব? অথচ ১৯৮৪ সালে এক নির্বাহী আদেশে বলা হয়েছিল, দেশের সব সাইনবোর্ড, যানবাহন নম্বর ফলক বাংলায় হতে হবে। এই আদেশের বাস্তবায়ন কি আমরা আজও দেখছি? ফলে দুঃখ হলেও চরম সত্য যে আমরা ভাষাশহিদদের সম্মান মাতৃভাষা সর্বস্তরে চর্চার মধ্য দিয়ে দিতে পারিনি। দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ এখনও অক্ষর জ্ঞানহীন। রেলস্টেশনের দিকে এগুলেই দেখা মিলে অগণিত পথশিশু অক্ষর জ্ঞানহীনভাবেই বেড়ে ওঠে। তারা শুধু মায়ের কোলে বসে যে ভাষাগুলো শিখে কিংবা সমাজে চলতে ফিরতে গিয়ে যা শিখে তাই দিয়ে জীবন কাটিয়ে দেন। সংবিধান অনুযায়ী শিক্ষা আমাদের মৌলিক অধিকার। শিক্ষা বর্তমানে পণ্যে পরিণত হয়েছে। শিক্ষা এখন কাঁচামালের মতো ভালো দামে বিক্রি হয়, কম দামে বিক্রি হয়। বাজারে গেলেই লক্ষ্য করা যায় যার পকেটে টাকার পরিমাণ বেশি ওই ব্যক্তি ভালো মানের পণ্য কিনতে সক্ষম কিন্তু যার পকেটের টাকার পরিমাণটা সামান্য তার জন্য বরাদ্দ তুলনামূলকভাবে খারাপ মানের পণ্য যা নিয়ে বাড়িতে ফিরেন। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার হাল এই দুই ব্যক্তির মতোই। মাতৃভাষা আন্দোলনের একাত্তর বছর আর দেশ স্বাধীনের বায়ান্ন বছর পার করছি অথচ শিক্ষায় ধনী গরিবের বৈষম্য দূর করতে পারিনি। তবে কি ভাষাসৈনিকরা এই বৈষম্য দূর করার জন্য নিজের বুকের তাজা রক্ত দিয়ে রাজপথ রক্তে রঞ্জিত করেননি?

অসাম্প্রদায়িক চেতনার অপর নাম একুশে ফেব্রুয়ারি। একুশ মানে ইতিহাস তৈরির প্রারম্ভিক স্থান, একুশ মানে জীবন সংগ্রামী ও বিপ্লবী ধারায় গড়ে তোলা ধারা, একুশ মানে ভাষাসৈনিক রফিক-শফিক-জব্বারের রক্তে রঞ্জিত রাজপথ, একুশ মানে মুক্তি, একুশ মানে মাতৃভাষা আন্দোলনে হাজারো স্মৃতিজড়িত শহিদ মিনার। ভাষাশহিদদের যথোপযুক্ত সম্মান দিলে হলে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রয়োগ করতে হবে, আদিবাসীদের নিজস্ব ভাষা শিক্ষার অধিকার দিতে হবে, বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দেশ স্বাধীনের এত বছর পরে এসেও যারা শহিদ মিনারে ফুল দেয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেন তাদের শক্ত হাতে দমন করতে হবে। সর্বোপরি নতুন প্রজম্মের কাছে মাতৃভাষা বাংলার গুরুত্ব এবং ঐতিহাসিক আন্দোলন ও রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলা ভাষার ইতিহাস তুলে ধরতে হবে। তবেই সম্মান করা হবে ভাষাসৈনিকদের, শ্রদ্ধাঞ্জলি জানানো হবে ভাষা শহিদদের।

জাফর হোসের জাকির

নীলফামারী