কাজী সালমা সুলতানা : ৩০ মার্চ, ১৯৭১। বাঙালির স্বাধীনতা যুদ্ধ ও হানাদার প্রতিরোধ ছড়িয়ে পড়তে থাকে। হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে থাকে। রাজধানী ছাড়াও মফস্বল শহর ও গ্রামে হানাদার বাহিনী হত্যাযজ্ঞ চালায় এবং বাড়িঘরে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিতে থাকে। এদিন মুক্তিযোদ্ধাদের আধিপত্য ভাঙতে পাকিস্তানি জান্তা সারা দেশে সৈন্য মোতায়েন শুরু করে। তবে সর্বত্রই তারা প্রতিরোধের মুখে পড়ে।
বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী রংপুর সেনানিবাস থেকে বের হয়ে রংপুর শহর ও সংলগ্ন গ্রামগঞ্জের ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। এতে বহু লোক প্রাণ হারায়। পাশাপাশি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় বাড়িঘর-মহল্লা-গ্রাম এবং পাশবিক অত্যাচার চালায়।
এদিন চট্টগ্রামের লালখান বাজারে বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী ও অবাঙালিরা মিলে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। কয়েক দিনের এমন বর্বর হত্যাকাণ্ডে প্রায় আড়াই হাজার বাঙালি প্রাণ হারায়। ওয়াসার মোড়ে কল থেকে পানি দেওয়ার গুজব রটিয়ে বাঙালিদের জড়ো করা হয়। এরপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে শত শত বাঙালিকে। চট্টগ্রামের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার দু’দিনের মধ্যেই পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী প্রতিরোধের মুখে পড়ে।
সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে চট্টগ্রাম স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি ও সাহায্যদানের জন্য বিশ্বের সব গণতান্ত্রিক সরকার এবং জনগণের প্রতি আবার আবেদন জানানো হয়।
বরিশাল, ফরিদপুর, সিলেট, ময়মনসিংহ, রাজশাহীসহ নতুন নতুন ফ্রন্টে পাক সেনারা নিহত হচ্ছে বলে খবর আসতে থাকে। যশোরের খণ্ডযুদ্ধ থেকে পালিয়ে এসে পাকিস্তানি সেনারা ঊর্ধ্বতনদের জানায় মুক্তিসেনাদের বীরত্বের কথা। ঢাকায় চোরাগুপ্তা হামলা করতে গিয়ে ধরা পড়ে দুই গেরিলা। ঢাকাতে আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে তল্লাশি শুরু করে পাক হানাদাররা।
সকাল ৮টায় ১০৭ ব্রিগেডের ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার এসএআর দুররানী যশোর সেনানিবাসের অস্ত্রাগারের চাবি নিজের কাছে নিয়ে নেন।
এদিন নাটোরের লালপুরে ‘ময়নার যুদ্ধে’ হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সুদৃঢ় প্রতিরোধ গড়ে তোলেন সাঁওতাল ও বাঙালিরা। এই সম্মুখযুদ্ধে সাঁওতাল তীরন্দাজসহ ৪০ বাঙালি শহীদ হন। যুদ্ধ চলাকালে তিনটি জেটবিমান আকাশে চক্কর দিতে থাকে। একটি হেলিকপ্টার থেকে খাদ্য ও রসদ জোগান দেওয়া হয় হানাদারদের। এই যুদ্ধে তীর ও গুলিবিদ্ধ সাত পাকিস্তানি সেনার লাশও পাওয়া যায়। ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট এ যুদ্ধে অংশ নেয়। যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে হানাদার সেনারা রাতের আঁধারে ছোট দলে বিভক্ত হয়ে পালাতে থাকে। পরদিন ফসলের মাঠসহ বিভিন্ন স্থানে লুকিয়ে থাকা পাকিস্তানি বাহিনীর মেজর রাজা আসলামসহ কয়েকজন ধরা পড়েন। লালপুর এসএস পাইলট হাইস্কুল মাঠে এক সংক্ষিপ্ত বিচারের পর তাদের গুলি করে হত্যা করা হয়।
বিকাল ৫টায় মতিন পাটোয়ারীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা কুষ্টিয়া পুলিশ লাইনস দখল করে নেন। গোদাবাড়ীতে অবস্থানরত ইপিআর বাহিনীর ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সর্বাত্মক আক্রমণ চালায়। এ সময়ে ইপিআর সৈনিক সিপাহি আবদুল মালেক শহীদ হন।
এদিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পার্লামেন্টে বলেন, ‘পূর্ব বঙ্গের সাড়ে সাত কোটি মানুষ তাদের স্বাধীনতার জন্য যে সংগ্রাম শুরু করেছে, ভারত তাতে সাহায্য না করে পারে না। ভারত তাই সংগ্রামে সাহায্য করেই যাবে।’ ভারতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়লে মন্ত্রিসভার জরুরি বৈঠক ডাকেন ইন্দিরা গান্ধী।
প্রাণ বাঁচাতে নিরীহ বাঙালিরা পালিয়ে পশ্চিম বঙ্গে চলে যায়। কলকাতায় প্রথমে খোলা হয় ত্রাণ কার্যালয়। পরে দ্রুত সময়ে ক্যাম্প গড়ে ওঠে। কয়েক লাখ শরণার্থীর পশ্চিমবঙ্গে যাওয়ার খবর শিরোনাম হয়ে ওঠে বিশ্বগণমাধ্যমে। এদিন অটল বিহারী বাজপায়ির নেতৃত্বে প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘের মিছিল হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রগতিশীল বামপন্থি সংগঠনগুলো বিক্ষোভ অব্যাহত রাখে কলকাতা ও দিল্লিতে। পশ্চিম বঙ্গের কংগ্রেসদলীয় মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শংকর রায় রাস্তায় নামেন উদ্বাস্তুদের ত্রাণের চাঁদা তুলতে। নকশালকর্মীরাও এগিয়ে আসেন সহায়তায়।
তথ্যসূত্র: মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও সংবাদপত্র
বাঙালির স্বাধীনতা
